প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে স্মার্ট সহায়ক শিক্ষার ভূমিকা

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:১৭ পিএম, ১৩ জুন ২০২৪

উত্তম কুমার দাশ

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়; এটি এখন প্রাত্যহিক বাস্তবতা। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট নাগরিকের কথা বলছি। কিন্তু স্মার্ট নাগরিক কিভাবে গড়ে উঠবে তা বিস্তারিত ভাবছি না। আমি মনে করি, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক তৈরির কারখানা। সরকার কারিকুলাম যুগোপোযোগী করে ঢেলে সাজিয়েছে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে; শিক্ষার্থীদের আইসিটি উপকরণের সাথে পরিচয় করানো হচ্ছে; তবু কোথাও যেন আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। তবু ঝরে পড়া শতভাগ রোধ হচ্ছে না; শতভাগ উপস্থিতি নেই শ্রেণিকক্ষে। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তবু এক ফ্রেমে সবাইকে আনা যাচ্ছে না।

আমার মনে হয়, শিক্ষকদের পাঠ্যপুস্তক নির্ভর শিক্ষা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সহায়ক শিক্ষার কাঠামো তৈরি করতে হবে। একটি স্কুলে একজন বাচ্চা যখন ভর্তি হয়; তখন প্রথমেই তাকে পাঠ্যপুস্তকের নৈকট্যে এমনভাবে নিয়ে আসা হয়, যা তার কাছে মানসিক চাপে পরিণত হয়। প্রথমত আমি মনে করি, প্রথমই বাচ্চাদের সামাজিক শিক্ষা পাঠদান ও অনুশীলন জরুরি। বাচ্চারা তোতাপাখির মতো বেড়ে উঠবে এটা কাম্য নয়। সহপাঠী যখন ভালো কিছু করছে; তখন অন্য আরেকটি বাচ্চা প্রশংসা করছে না। ভুল করলে ‘সরি’ বলছে না বরং কোনো সহপাঠী পড়ে গেলে হাসছে; হাত ধরে তুলছে না। আর ভাগাভাগি করা তো একবারেই নেই বললেই চলে। বরং কাউকে কিছু দিতে হবে শুনলে সে তার উদ্বৃত্ত জিনিসটি লুকিয়ে রাখছে। আমরা বাচ্চাদের এই শিক্ষাটা দিতে পারছি না।

দ্বিতীয়ত সামাজিক মূল্যবোধ ও শিষ্টাচারের কথা বলতে হয়, যা শিশুর মনে গেঁথে দেওয়া একান্ত জরুরি। প্রাথমিকের শিক্ষকরা হচ্ছেন কুমোরের মতো; কুমোর যেমন মাটির ঢেলাকে বিভিন্ন আকৃতি দেয়, তেমনই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরাও সামজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে একটি শিশুকে সুনাগরিকের আকার আকৃতি দিতে পারেন এবং দিচ্ছেনও বটে। ইদানীং কারো বাসায় যখন আমরা যাই, ড্রয়িং রুমে এখন আর বাচ্চাদের দেখা যায় না। এগিয়ে এসে মেহমানদের সালাম দিচ্ছে না; কেননা তারা এখন নিজস্ব ভুবন তৈরি করে ফেলেছে একাকি রুমে। এমনকি নিজের ভাই-বোনদের সাথেও শেয়ারিং কমে যাচ্ছে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার কোনো খেয়াল নেই, সে নির্বিকার। এমন স্বপ্রণোদিত বন্দিত্ব থেকে বাচ্চাদের মুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত বাচ্চাদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা বাচ্চাদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ আর স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, প্রজেক্টর সেট করে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি যে আমরা বাচ্চাদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে ঢের করেছি। আসলে তা নয়। আমরা কি ক্লাসে মজার মজার বিজ্ঞানের গল্প বলি, ক্লাসে কি মজার মজার বিজ্ঞানের ট্রিকস দেখাই? তাদের কি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানিদের শৈশবের মজার মজার গল্প শোনাই? যদি না করি, তবে তাদের মনে বিজ্ঞানের বীজ কিভাবে অঙ্কুরিত হবে। সে যদি জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশের রংধনু দেখতে আগ্রহী না হয়, সে যদি কল্পনায় হারিয়ে না যেতে পারে, সে যদি প্রজাপতির পাখনার রং দেখে উদ্বেলিত না হয়; তার মনে যদি হাজারো প্রশ্ন না জাগে: তবে তার স্বপ্ন সীমাবদ্ধ হবে। আমাদের এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে শিশুর চোখের সামনে বিজ্ঞানের সীমাহীন রঙিন দ্বার মেলে ধরতে হবে।

চতুর্থত পরিমিত স্বাস্থ্য। আমি যে প্রজন্মের মানুষ; সেই প্রজন্মে শিক্ষকদের কথা আমরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম কিন্তু একই বিষয়ে মা-বাবার কথা শুনতাম না। শিক্ষকরা ভুল শেখালেও সেটাই সঠিক বলে গ্রহণ করতাম। আমরা পড়ার সময় পড়তাম, খেলার সময় খেলতাম, ঘুমানেরা সময় ঘুমাতাম। আর ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠতাম। আমরা স্কুলে না গেলে অসুস্থ হয়ে যেতাম আর গেলে সুস্থ থাকতাম। গোল্লাছুট, কাবাডি, ফুটবল খেলার দরুণ আমাদের ছোট শরীরে কোনো বাড়তি মেদ ছিল না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বাচ্চারা এখন ডায়বেটিস, স্থুলকায় রোগে ভুগছে। একটুখানি দৌড়ঝাঁপ করলে পা ব্যথা করে। শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখাটাও জরুরি। ক্লাসেই তাদের জানিয়ে দিতে হবে, কোন ফলে কোন ভিটামিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হবে প্রাত্যহিক কর্ম। এককথায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে বাচ্চাদের সহায়ক জ্ঞান না থাকলে তারা পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে উঠতে পারবে না। মেধা-মনন সৃজনশীলতা বিকাশে পরিমিত স্বাস্থ্য ও পুষ্টি জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক।

পরিশেষে বলবো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টর (এসডিজি) অন্যতম অনুষঙ্গ। নিয়মিত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষককে তার স্কুলের বাচ্চাদের মেধা-মননের উৎকর্ষ সাধনের জন্য নিজস্ব একটি স্মার্ট সহায়ক পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। আমি শিক্ষক নই, তবু Social soft skills, social Skills, Science Ambitious এবং sound health এই চারটি উপাদানে 4S সহায়ক পদ্ধতির অবতারণা করেছি।

আমাদের শিক্ষকদের কার্যকর সহায়ক শিখন পদ্ধতিই পারে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মেধা মননের বুনিয়াদ মজবুত করে তুলতে। যাতে প্রাথমিক শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ২০৩০ অর্জিত হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষা হবে স্মার্ট নাগরিক তৈরির আঁতুড়ঘর।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কালকিনি, মাদারীপুর।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।