খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট বৃদ্ধি, ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে

খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব পণ্যের ওপর ঢালাও আড়াই শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধি ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে। যারা নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছে তাদের বিপদ বেশি হবে, প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারবেন না তারা। যারা ভ্যাট ট্যাক্স দিচ্ছেন না তাদের উপকারই বেশি হলো। অথচ দরকার ছিল ভ্যাটের হার কমিয়ে আদায় বাড়ানো। সেদিকে না গিয়ে উল্টো যারা ভ্যাট দিচ্ছেন তাদের ওপর বাড়তি ভ্যাটের হার চাপিয়ে দেওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট করার কারণে শিল্পখাত হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ আসা শুরু করেছিল। ইতোমধ্যে স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার, হোম অ্যান্ড পার্সোনাল কেয়ার ও বিউটি প্রোডাক্টের খাতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ এসেছে। যার ফলে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু নতুন ভ্যাট নীতি খুচরা পর্যায়ে ওই পণ্যের বিক্রির ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এতে করে উৎপাদন খরচ, পণ্যের দাম বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতার চাপ, কর্মসংস্থানের সংকোচন এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের অনিশ্চয়তা বেড়ে যাবে। দেশীয় শিল্পের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় ব্যবসায় বিকাশমান ধারা অব্যাহত রাখতে ভ্যাট বাড়ানোর পরিবর্তে সুবিধাজনক কর নীতি প্রণয়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। শুধু ওইসব খাতই নয় বরং সার্বিকভাবে বাড়তি ভ্যাট বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলেই দাবি করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে যেখানে দেশের জনগণ প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখন ভ্যাট হার বাড়ানোর কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টর্স অব বাংলাদেশ (এএসবিএমইবি) এর জেনারেল সেক্রেটারি জামাল উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশে অনেক ব্যবসা আছে যারা নিয়মিত ভ্যাট ট্যাক্স দিচ্ছেন না। যেমন- কসমেটিকস শিল্পের আইটেমগুলো অধিকাংশ চোরাই পথে বিনা শুল্কে দেশের বাজারে ঢুকছে। আর যারা নিয়মমতো ভ্যাট ট্যাক্স পরিশোধ করে কসমেটিকস ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের ওপর এই বাড়তি চাপ একটা অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। এই প্রতিযোগিতায় চোরাই পণ্যের সঙ্গে আসল পণ্যের টিকে থাকা মুশকিল হবে। আমরা মনে করি, ভ্যাটের হার কমিয়ে সবার কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা সুসংহত করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট হার বৃদ্ধির প্রভাব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করবে, মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিক্রয় হ্রাস পাবে। যার প্রভাবে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা ও আয় সংকুচিত হতে পারে। পাশাপাশি কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন সেবার ওপর ভ্যাট হার বৃদ্ধির কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। যা দেশীয় শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করবে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) এর সহ-সভাপতি এম এস সিদ্দিকী বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত ছিল, যা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে ভোক্তাকে কোনো পণ্য কিনতে অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ টাকা বেশি খরচ করতে হবে। এতে জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বাড়লো। পণ্য কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত দামের কারণে ভোক্তার অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে, যাতে করে স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসেন বলেন, সম্প্রতি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এখনও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট হার বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী মনে করছেন, ভ্যাট বাড়ার কারণে এর প্রভাব স্থানীয় শিল্পের ওপর মারাত্মক হতে পারে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতার চাপ, কর্মসংস্থানের সংকোচন, এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের অনিশ্চয়তা বাড়বে। সব মিলিয়ে দেশীয় শিল্পের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। সুতরাং, সরকার যদি দেশীয় শিল্পের উন্নতি এবং প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চায়, তবে ভ্যাট বৃদ্ধি না করে বরং সামঞ্জস্যপূর্ণ কর নীতি প্রণয়ন করা উচিত, যাতে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় ব্যবসা সমূহ পূর্ণ সম্ভাবনা অনুযায়ী বিকশিত হতে পারে।
জেএইচ/এএসএম