ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ৫৯ হাজার কোটি টাকা
ব্যাংকিং খাতে বেড়েছে মন্দ ঋণের (খেলাপি ঋণ) পরিমাণ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে এসব মন্দ ঋণের কারণে যেসব ব্যবসায়ী সৎ ভাবে ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করছে তারা নিরুৎসাহীত হবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ সম্পর্কে এখনই সতর্ক ও সচেতন না হলে আগামীতে অনেক ব্যাংক তাদের অস্তিত্ব হারাবে।
খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা সর্বশেষ (জানুয়ারি-মার্চ‘২০১৬) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, একদিকে ব্যবসা বাণিজ্য ভালো হচ্ছে না অন্যদিকে গত বছরের মত ঋণ পুনর্গঠনে সুযোগের অপেক্ষায় থাকার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এছাড়াও আমাদের ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণে দক্ষতা ও জবাবদিহীতার অভাব রয়েছে। আর এর ফলে, আগামীতে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাবে। হ্রাস পাবে ঋণ বিতরণ। একই সঙ্গে লভ্যাংশ কমবে শেয়ারহোল্ডারদের।
তিনি আরো বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ঋণ বিতরণে কর্মকর্তাদের পারফরমেন্সের উপর পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনক। এসব মন্দ ঋণের কারণে যেসব ব্যবসায়ী সৎ ভাবে ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করছে তারা নিরুৎসাহীত হবে।
তিনি বলেন, ৫৯ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ মানে মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশই খেলাপি। আর ব্যাংকিং খাতে এ খেলাপি না হলে নিম্নমুখী ঋণের সুদহার আরো কমানো সম্ভব হত।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে ব্যাংকিং খাতে প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হবে। তাই কি কি কারণে ঋণ খেলাপি হচ্ছে তা বের করতে হবে। এবং এসব কারণ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে আইন চেঞ্জ করে এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে। এছাড়াও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে একই সঙ্গে এর উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দুর্নীতির আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো অতি আগ্রাসীভাবে এ লোনগুলো দিয়েছে। ফলে এই ঋণ আদায় হবে না। যা হবে তা খুব সামান্য। বাকিগুলো ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলো লোকসান দেখাবে। অর্থাৎ যা গেছে তা আর ফিরে আসবে না।’
এ থেকে বেরিয়ে আসা যায় কিভাবে তা জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এসব ঋণ সম্পর্কে এখনই সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। তা না হলে অনেক ব্যাংক তাদের অস্তিত্ব হারাতে পারে।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা; যা এ ৫৬ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক।
এটি আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্তও এই ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৪৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায়; যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিদেশি ৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, বেসরকারি ৩৯ ব্যাংকের ৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৪ কোটি, বিদেশি ৯ ব্যাংকের ২৪ হাজার ২৫৯ কোটি এবং বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ২১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।
এসআই/এআরএস/এবিএস