কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৩৪ পিএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২৫
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও পারছে না বাংলাদেশ/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার। বছরের পর বছর যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে না আয়। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয় না মেলাতে পেরে বিপাকে দেশবাসী।

গত পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল মূল্যস্ফীতি। ২০২০ সালের নভেম্বরে সাধারণ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। এরপর ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এটি। ২০২১ সালের নভেম্বরে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০২২ সালের নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৯ দশমিক ৪৯ ও ২০২৪ সালের নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ হয় মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে।

২০২৪ সালের নভেম্বরে দেশবাসীকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে খাদ্যপণ্য। এই মাসে খাদ্যখাতে মূল্যস্ফীতির সব রেকর্ড ভেঙে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়। অর্থাৎ এক বছর ব্যবধানে ১০০ টাকার খাদ্যপণ্য কিনতে ২০২৪ সালে ১৩ টাকা ৮০ পয়সা বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।

মূলত অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বেশিরভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এক অঙ্কের ঘরে রাখতে পারলেও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

‘বাজার সিন্ডিকেট ও অর্থপাচার না হলে মূল্যস্ফীতি এভাবে গেড়ে বসতো না। কৌশলে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একটা মুদ্রানীতি। যাতে খাদ্যের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সহায়ক হতে পারে। কিন্তু চাল-ডালের দাম কমানো কঠিন। বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা ব্যর্থ কৌশল। বাজার মনিটরিংয়ের নামে পুলিশিং করা হচ্ছে, এটা দিয়ে হবে না।’- অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরও নানা বিষয় আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাজার সিন্ডিকেট ও অর্থপাচার। এছাড়া টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নানান কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য বাজার সিন্ডিকেটও দায়ী। পাশাপাশি অর্থপাচার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। অর্থপাচার না হলে মুদ্রাবিনিময় হার এতো হতো না। অর্থপাচার না হলে ডলারের দাম বাড়তো না। অর্থপাচারের ফলে টাকার মূল্য কমেছে। টাকার মূল্য কমায় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা পুলিশিং করা হয়েছে। এতে সুফল পাইনি, কুফল পেয়েছি। পুলিশ দিয়ে বিক্রেতাদের ধমকালে তারা বাজারে আসেনি ভয়ে। ফলে দামও বেড়েছে।’

জাহিদ হোসেন বলেন, ‘একদিকে টাকা ছাপানো হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। বাজার সিন্ডিকেট ও অর্থপাচার না হলে মূল্যস্ফীতি এভাবে গেড়ে বসতো না। কৌশলে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একটা মুদ্রানীতি। যাতে খাদ্যের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সহায়ক হতে পারে। কিন্তু চাল-ডালের দাম কমানো কঠিন। বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা ব্যর্থ কৌশল। বাজার মনিটরিংয়ের নামে পুলিশিং করা হচ্ছে, এটা দিয়ে হবে না।’

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯ সংকট কাটিয়ে উঠছিল, তখনই শুরু হয় এ যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের লড়াই শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের নানান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা মূল্যস্ফীতি কমাতে উদ্যোগ নেয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জয়ী হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো নাগালের বাইরে।

শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছিল ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশে। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নয়, মূল্যসংকোচনের ধারায় রয়েছে দেশটি। অর্থাৎ দেশটির বাজারে পণ্যের দাম না বেড়ে উল্টো কমছে।

শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়ালেও পারছে না বাংলাদেশ

আড়াই বছর আগে শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটিতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছিল ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশে। পাঁচ বছরের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ।

২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২২ সালের নভেম্বরে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ ও ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নয়, মূল্যসংকোচনের ধারায় রয়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থাৎ দেশটির বাজারে পণ্যের দাম না বেড়ে উল্টো কমছে। গত বছরের নভেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ১০ শতাংশ, ডিসেম্বরে ছিল ঋণাত্মক ১ দশমিক ৭ শতাংশ

অর্থনীতি চাঙা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে মুদ্রানীতি কঠোর করে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছে, সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করে বাজেট ঘাটতি কমিয়েছে, বার্ষিক ঘাটতি কমাতে ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে এবং ঋণ পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও কৃষিখাতে উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানে গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২৩ সালের মে মাসে। ৩৭ দশমিক ৯৭ শতাংশে উঠে যায় মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আরও কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

মূল্যস্ফীতি ৪-এ নামিয়ে এনেছে পাকিস্তান

পাকিস্তানে গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২৩ সালের মে মাসে। ৩৭ দশমিক ৯৭ শতাংশে উঠে যায় মূল্যস্ফীতি। ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে ১১ দশমিক ৫, ২০২২ সালের নভেম্বরে ২৩ দশমিক ৮, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ২৯ দশমিক ২৩ ও ২০২৪ সালের নভেম্বরে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি আরও কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ভারতসহ অন্যরা

গত পাঁচ বছরে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে ৪ দশমিক ৯১, ২০২২ সালের নভেম্বরে ৫ দশমিক ৮৮, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৫ দশমিক ৫৫ ও ২০২৪ সালের নভেম্বরে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে এই মূল্যস্ফীতি কমে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে বলে ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নেপালে গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২০ সালের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে ৬ দশমিক ০৪, ২০২২ সালের নভেম্বরে ৮ দশমিক ০৮ ও ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নভেম্বরে নেপালের মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে ভুটানে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২০ সালের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে ৭ দশমিক ২৬, ২০২২ সালের নভেম্বরে ৪ দশমিক ৫৯ ও ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নভেম্বরে ভুটানের মূল্যস্ফীতি কমে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমেছে।

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

একই অবস্থা মালদ্বীপে। গত পাঁচ বছরে সেখানে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২২ সালের জুন মাসে, ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২০ সালের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০২১ সালের নভেম্বরে দশমিক ১৩, ২০২২ সালের নভেম্বরে ২ দশমিক ৮৪, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ২ দশমিক ১৩ ও ২০২৪ সালের নভেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ।

‘সরকার খুচরা ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। প্রভাব বিস্তারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এগুলো করলে হবে না। বড় কারসাজিকারীদের ধরতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। সামগ্রিকভাবে পুরো বাজার ব্যবস্থা একটা প্যাকেজের আওতায় নিতে হবে।’- অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি

বাংলাদেশে কেন কমছে না মূল্যস্ফীতি

দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের নানান দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাড়ছে বাংলাদেশে। কেন কমছে না মূল্যস্ফীতি? এই প্রশ্নের জবাবে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি জাগো নিউজকে বলেন, নানান কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বর্তমান সময়টা নানান কারণে জটিল। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে কিন্তু মূল্যস্ফীতি ১০ থেকে ১১ শতাংশে আছে। মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমানো যায় না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি সংকোচন করা হয়েছে, তারপরও কমছে না। মুদ্রা সরবরাহ কমলে চাহিদা সংকুচিত হয়, তখন দাম কমবে।

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

‘শুধু চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নয়, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে। বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট আছে। বড় বড় জায়গায় বাজার কারসাজি হয়। তারা বড় মুনাফা অর্জন করে। সরকার বাজার মনিটরিং করছে কিন্তু মূল জায়গায় হাত দিচ্ছে না। খুচরা পর্যায়ে সমস্যা আরও গভীরে। সিন্ডিকেটে যারা জড়িত তাদের ধরতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘একটা দ্রব্যের মূল্য বাড়লে অনেক কিছুর দাম বাড়ে। বাজারে একটা সরবরাহ চেইন থাকে, এটা ঠিক করতে হবে। উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তার কাছে যাওয়ার আগে অনেক পার্টিসিপেন্ট থাকে। পণ্যের ক্ষেত্রে পার্টিসিপেন্ট অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকার হলে তারা নিজেদের স্বার্থে মুনাফা অর্জন করবে। এদের সঠিকভাবে ধরতে হবে। সাপ্লাই চেইন বা মূল্য শৃঙ্খলা চেইন থাকে, এটা ঠিকঠাক কাজ করতে হবে। পরীক্ষা করতে হবে কারা অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহার করছে, তাদের ধরতে হবে। সরকার খুচরা ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। প্রভাব বিস্তারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এগুলো করলে হবে না। বড় কারসাজিকারীদের ধরতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। সামগ্রিকভাবে পুরো বাজার ব্যবস্থা একটা প্যাকেজের আওতায় নিতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা চাহিদাগুলোকে একটা সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিতে হবে।’

মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায়

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির আগুন থেকে উত্তরণের একটাই পথ, এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল রাখা। ডলারের চাহিদা বেড়ে যাতে মূল্যস্ফীতি উসকে না দেয়। বাজার ব্যবস্থা স্বচ্ছতা রাখতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা কৌশলে পরিবর্তন করতে হবে। সরকার নির্ধারিত দাম ধরে রাখার চেষ্টা করছে, এটা হবে না। যেখানে পুলিশিং কায়দা দরকার, সেটা হচ্ছে না। বাজার ব্যবস্থা সাপ্লাই চেইনে চাঁদাবাজি সমস্যা। এখানে পুলিশিং কাজ করলে কাজে দেবে।’

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

‘চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। খুচরা পর্যায়ে হুমকি-ধামকি দিলে হিতে বিপরীত হয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে না। বাজারে কারসাজি করে বড় খেলোয়াড়। ভোক্তা অধিকারের লোকজন দিয়ে বকাঝকা করে ফাইন ধরাই দিলো, গলাবাজি বা ডান্ডাবাজি করে বাজার বশে আনা যায় না। বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা জরুরি। চাল, ডাল, গম ভোজ্যতেল, চিনি সরবরাহ পর্যায়ে কী পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে এখানে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এগুলো জানার হেলদি ব্যবস্থা থাকতে হবে।’ যোগ করেন জাহিদ হোসেন।

‘নিত্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলে উৎপাদন খরচ কমলে স্বস্তি হতে পারে। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়েছে, তারপরও সুফল পাওয়া যায়নি। সরকারের বাজার তদারকির কাজও দুর্বল। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।’- ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন

দিন দিন কঠিন হচ্ছে জীবন-জীবিকা

সরকারের বাজার তদারকির কাজে দুর্বলতা রয়েছে। এছাড়া বাজার সিন্ডিকেট নামক একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী বাজার অস্থিতিশীল করছে। বাজার সিন্ডিকেট বলতে কিছু আছে সরকার এটা বিশ্বাস করছে না বলে মনে করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

নিত্যপণ্য ক্রেতাদের নাগালের বাইরে যাওয়া প্রসঙ্গে ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম না কমার পেছনে খাদ্যসামগ্রী অন্যতম দায়ী। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো ইতিহাস নেই, শুধু বাড়ে। বিশ্ববাজারে বাড়লে এখানে বাড়ছে, বিশ্বে কমলে এখানে কমে না। মানুষের জীবন-জীবিকা দিন দিন কঠিন হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলে উৎপাদন খরচ কমলে স্বস্তি হতে পারে। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়েছে, তারপরও সুফল পাওয়া যায়নি। সরকারের বাজার তদারকির কাজও দুর্বল। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।’

‘ডলারের দাম স্থিতিশীল না হলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না। মূল্যস্ফীতি আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ছে। বাজারের সঙ্গে সঠিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে হবে। অহেতুক বাজার ব্যবস্থা সংকোচন করা যাবে না। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সঠিকভাবে দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি চেপে ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্ববাজারের মতো ছেড়ে দিতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।’- টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম

গুটিকয়েক কোম্পানির আধিপত্য

বাজারে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুটিকয়েক কোম্পানির আধিপত্য থাকায় প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই। এ কারণে পণ্যের দাম যথেচ্ছভাবে বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমালেও সেটি আসলে শেষমেশ গিয়ে কোনো সুফল বয়ে আনে না। কারণ আমদানি করেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী।

কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন ব্যবসায়ীদের বাজারে ঢোকার প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। বাজারে প্রতিযোগিতার জায়গা মসৃণ করতে হবে, যাতে নতুন ব্যবসায়ীরা সহজে ঢুকতে পারেন। এসব প্রতিযোগিতার পথ মসৃণ ও স্বচ্ছতা জরুরি। সরকার আমদানির ওপর শুল্ক কমিয়েছে। বেনিফিট কোথায় ঢুকলো দেখতে হবে। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের ধরতে হবে। আমদানির পথ উন্মুক্ত করা মানে প্রতিযোগিতার বাজার উন্মুক্ত করা। বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।

তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলারের দাম স্থিতিশীল না হওয়ায় বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এছাড়া শিল্প-কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায়ও বাড়ছে পণ্যের দাম।

পণ্য আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী বড় প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) শফিউল আতহার তসলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ডলারের দাম স্থিতিশীল না হলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না। মূল্যস্ফীতি আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ছে। বাজারের সঙ্গে সঠিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে হবে। অহেতুক বাজার ব্যবস্থা সংকোচন করা যাবে না। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সঠিকভাবে দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি চেপে ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্ববাজারের মতো ছেড়ে দিতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।’

‘গ্যাস-বিদ্যুতের খরচ কমাতে হবে। দিনে পাঁচ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঁচ ঘণ্টা কাজ করিয়ে ২৪ ঘণ্টার বেতন দেওয়া হচ্ছে। এটা আমরা কীভাবে পুষিয়ে নেবো? এসব কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অথচ মূল্যস্ফীতি বাড়লে ব্যবসায়ীদের টার্গেট করা হয়, এটা সঠিক নয়।’ বলেন শফিউল আতহার তসলিম।

এমওএস/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।