৮ বছর বন্দরে পড়ে আছে ‘মিথ্যা ঘোষণার পণ্য’, উদাসীন কাস্টমস
এক ধরনের পণ্যের ঘোষণা দিয়ে আরেক ধরনের পণ্য আমদানি করার ঘটনা নতুন নয়। মিথ্যা ঘোষণার এমন অনেক কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়ে। অনেক আমদানিকারক আবার বিভিন্ন কারণে পণ্য খালাস নেন না। সেসব কনটেইনার পড়ে থাকে বন্দরে। ‘নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য’ হলেও এসব কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উদাসীন কাস্টমস।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মামলা না থাকলে বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্য নির্ধারিত ফি দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে খালাস নিতে হয়। না নিলে সেটা নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য বিবেচনা করা হয়।
বন্দরের তথ্যমতে, ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৯৭২ টিইইউএস (২০ ফুট সমমান)। এসব কনটেইনারের ভিতরে রয়েছে একলাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পণ্য। এছাড়া বন্দরের বিভিন্ন শেডে দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে তিন হাজার ৫৬০ টন এলসিএল এবং পাঁচ হাজার ৪৪৩ টন বাল্ক কার্গো (খোলা পণ্য)। এর মধ্যে একমাস থেকে ২০ বছরের পুরোনো কনটেইনার এবং পণ্যও রয়েছে।
৮ বছর পড়ে আছে ‘মিথ্যা ঘোষণার পণ্য’
রাজধানী ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’। ২০১৭ সালে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণা দিয়ে তারা চীন থেকে এক কনটেইনারে আমদানি করে ১৪৪ প্যাকেজ পণ্য। আমদানিকারকের প্রতিনিধি চট্টগ্রামের ধনিয়ালাপাড়া ডিটি রোড এলাকার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাবেয়া অ্যান্ড সন্স ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করে। যার নম্বর-২৯১৪২১।
সন্দেহজনক পণ্য থাকার আশঙ্কায় কাস্টমস পণ্যের চালান খালাস প্রক্রিয়া স্থগিত করার জন্য অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড লক করে দেয়। কিন্তু আট বছর ধরে এ লক কেন খোলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কিংবা কেন নির্ধারিত সময়ে নিলামের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।- চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু
নিয়মবহির্ভূত পণ্য আমদানি সন্দেহে ওই দিনই চালানটির খালাস প্রক্রিয়া লক করে দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা ও এআইআর। পরে আর এসব পণ্য খালাস নেননি আমদানিকারক। এরপর দীর্ঘ আট বছরেও ওই লক খোলার উদ্যোগ নেয়নি কাস্টমস। কেন পণ্য খালাস নেওয়া হচ্ছে না, সেটাও আমদানিকারক কিংবা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছে জানতে চায়নি কাস্টমস। কনটেইনারটির কেন খালাস করা হচ্ছে না, সে বিষয়েও তদারক করেনি শিপিং এজেন্ট।
- আরও পড়ুন
- চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট কমছে
- ১৪ বছর পর দাহ্য পণ্যের চার কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস
- চট্টগ্রাম বন্দরে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে: এম সাখাওয়াত
চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন পরিদর্শনে এসে বন্দরের কনটেইনার জট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানকে দীর্ঘদিন থেকে বন্দর অভ্যন্তরে পড়ে থাকা কনটেইনার দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। না হলে বন্দর চেয়ারম্যানকে এসব কনটেইনার নিলামে তুলতে বলেন।
এর পরপরই এনবিআর দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে পড়ে থাকা আমদানি করা পণ্য নিলাম ও ধ্বংস কার্যক্রমের লক্ষ্যে পণ্য ইনভেনটরি করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে। এনবিআর, কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দা এবং এআইআর কর্মকর্তাদের দিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য পণ্যের কনটেইনারগুলোর পণ্য ইনভেনটরি শুরু করে।
এর মধ্যে আট বছর আগে লক করা আমদানিকারক হেনান আনহুই এগ্রো এলসির নামে আসা কনটেইনারটি ইনভেনটরি করতে গিয়ে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য পান। আমদানিকারক ওই চালানটিতে পোল্ট্রি ফিডের ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণা দেয়। কিন্তু সোমবার কায়িক পরীক্ষায় কনটেইনারটিতে পাওয়া এলইডি টিভি ও বেনসন সিগারেট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চালান লক হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পরে ২০১৭ সালের ৫ ও ৬ মার্চ অভিযান চালিয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একই আমদানিকারকের পোল্ট্রি ফিডের ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণা দিয়ে আনা ১২টি কনটেইনার আটক করে। এরপর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে কনটেইনারগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি সিগারেট, এলইডি টিভি, ফটোকপি মেশিন ও মদ পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। ওই ঘটনায় ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ এবং ‘এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’ নামে দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৪০ কোটি পাচারের তথ্য পায় কাস্টমস।
এটি আগেও ইনভেনটরি করা যেত। তবে কনটেইনারের মালিক প্রতিনিধি শিপিং এজেন্টও কনটেইনারটি খালাসের বিষয়ে কখনো জানতে চাননি। বন্দরকে কনটেইনার জটমুক্ত করতে সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।- চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দুটি ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ এবং ‘এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’র মালিক আবদুল মোতালেব নামে এক ব্যক্তি। ২০২১ সালের ২০ জুন তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থপাচারের মামলাও।
প্রশ্ন উঠেছে, এত কিছু জানার পরেও সোমবার ইনভেনটরি করার জন্য খোলা কনটেইনারটি নিয়ে কাস্টমসের উদাসীনতা নিয়ে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের কনটেইনার জট কমাতে কাজ করছে কাস্টমস। এরই মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনারগুলোর পণ্য নিলাম ও ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।’
এর মধ্যে আট বছর আগে লক করা একটি চালানে মিথ্যা ঘোষণার পণ্য পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সন্দেহজনক পণ্য থাকার আশঙ্কায় কাস্টমস পণ্যের চালান খালাস প্রক্রিয়া স্থগিত করার জন্য অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড লক করে দেয়। কিন্তু আট বছর ধরে এ লক কেন খোলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কিংবা কেন নির্ধারিত সময়ে নিলামের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।’
শুধু ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’র নামে আমদানি হওয়া পণ্য নয়, গত ২২ ডিসেম্বর আরেকটি চালান নিলামে তোলার জন্য ইনভেনটরি করতে গেলে পাঁচ বছর আগে আমদানি করা একটি চালানে মিথ্যা ঘোষণার পণ্য পায় কাস্টমস। কাস্টমসের তথ্যমতে, রাজধাীন ঢাকার তোপখানা রোডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লোটাস সার্জিক্যাল হুইল চেয়ার ঘোষণায় তিনটি কনটেইনার পণ্য আমদানি করে। কিন্তু দীর্ঘদিন খালাস না নেওয়ায় কাস্টমসের নিলাম টিম গত ২২ ডিসেম্বর ইনভেনটরি করতে গেলে তিনটির মধ্যে দুই কনটেইনারে ইট ও ৩৯টি হুইল চেয়ার পান। অথচ আমদানিকারক ২০১৯ সালের এপ্রিলে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে খালাসের জন্য পণ্যের ঘোষণা দেয়। ওই চালানটি চীনের গুয়াংডংয়ের গুয়াংডং সেইলিং ট্রেড গ্রুপ থেকে আমদানির কথা বলা হয়। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দাবি, হুইল চেয়ার আমদানির ঘোষণায় আমদানিকারক ইট এনে অর্থপাচার করেছেন।
একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ নয় মাস বন্দর অভ্যন্তরে পড়ে থাকার পর একটি মদের চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা। এ ঘটনার আগে ৪ সেপ্টেম্বর রাতেই চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি ইয়ার্ডে ফেব্রিক্স ঘোষণায় শুল্কায়ন হওয়া কনটেইনারটি ফোর্স কিপডাউন করে। এরপর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করে এআইআর টিম। বৃহস্পতিবার সকালে কায়িক পরীক্ষা শেষে ২০ ফুটের কনটেইনারটিতে ১ হাজার ১১৪ কার্টনে বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের মদ উদ্ধারের বিষয়টি জানানো হয়। এতে ১১ ব্র্যান্ডের ১১ হাজার ৬৭৬ লিটার মদ পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর চালানটি ফেব্রিক্স ঘোষণা দিয়ে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়।
আমদানি করা পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ পণ্য খালাস হয় তার ৫ শতাংশ পণ্যও কাস্টমস শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে পারে না। এ ধরনের জনবল কিংবা লজিস্টিক সাপোর্টও কাস্টমের কাছে নেই। বাকি ৯৫ শতাংশ পণ্য কাস্টমস নিয়ম মেনে খালাস হয়। দুষ্টচক্রের লোকেরা এখানটাতেই সুযোগ নেয়।- চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ তফসির উদ্দিন ভুঁঞা
চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাস্টমসের পক্ষ থেকে সন্দেহজনক পণ্যের চালানটি লক করে দেওয়া হয়েছিল। লক করার কারণে চালানটি খালাস নিতে পারেনি আমদানিকারক। দীর্ঘদিন খালাস না হওয়ায় আমরা এসব পণ্য নিলামে তোলার জন্য ইনভেনটরি শুরু করেছি। এতে মিথ্যা ঘোষণার প্রমাণ পাওয়া যায়।’
লক করার পরেও আট বছর পরে ইনভেনটরি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আগেও ইনভেনটরি করা যেত। তবে কনটেইনারের মালিক প্রতিনিধি শিপিং এজেন্টও কনটেইনারটি খালাসের বিষয়ে কখনো জানতে চাননি। বন্দরকে কনটেইনার জটমুক্ত করতে সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।’
কনটেইনারের জটলা সম্পর্কে বন্দর সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমদানি পণ্য নিয়ে আসা কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর নির্ধারিত সময়ে খালাস না হয়ে ৩০ দিন পেরুলেই আমরা কাস্টমসকে রিমুভাল লিস্ট দেই। প্রতি মাসেই রিমুভাল লিস্টগুলো আপডেট হয়। এখন এসব কনটেইনার কেন দীর্ঘদিন পড়ে থাকছে কিংবা কেন তারা পণ্য খালাস কিংবা নিলামের পদক্ষেপ নেন না সেটা কাস্টমস অথরিটি বলতে পারবে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ তফসির উদ্দিন ভুঁঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমদানি করা পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ পণ্য খালাস হয় তার ৫ শতাংশ পণ্যও কাস্টমস শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে পারেন না। এ ধরনের জনবল কিংবা লজিস্টিক সাপোর্টও কাস্টমের কাছে নেই। বাকি ৯৫ শতাংশ পণ্য কাস্টমস নিয়ম মেনে খালাস হয়। দুষ্টচক্রের লোকেরা এখানটাতেই সুযোগ নেয়।’
তিনি বলেন, ‘দুষ্টচক্র কিংবা মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি ঠেকাতে কাস্টমসের কয়েকটি উইং রয়েছে। এর মধ্যে রিস্ক ম্যানেজমেন্টের আওতায় মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ঠেকানোর কাজ করে এআইআর।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি কিংবা রপ্তানি ঠেকাতে কাস্টমস সব সময় চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করে। এর মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম ঘটে। এখন ৮-১০ বছর আগে আমদানি করা খালাস না হওয়া পণ্যের মধ্যে মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। মূলত কাস্টমসের দক্ষতা ও নজরদারির কারণেই আমদানিকারকরা মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যগুলো খালাস নিতে পারেনি। এখন কনটেইনারগুলো সরানোর জন্য ইনভেনটরি করতে গেলে মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি ধরা পড়ছে। এসব চক্রে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম