আইডিআরএর ‘লুটের প্রকল্প’, বন্ধে নেই উদ্যোগ
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর বিশেষ আগ্রহে চালু করা হয় ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি)। গ্রাহককের পলিসি সংক্রান্ত তথ্য জানাতে মোবাইল ফোনে এসএমএস (ক্ষুদে বার্তা) পাঠানোর জন্য চালু করা হয় এ প্ল্যাটফর্ম।
এসএমএস পাঠানোর এ কাজটি দেওয়া হয় তৃতীয়পক্ষ ‘দুয়ার সার্ভিস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। কোনো প্রকার দরপত্র আহ্বান ছাড়াই অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে এ কাজ দেওয়া হয়। ফলে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিমা কোম্পানিগুলোর শতকোটি টাকা চলে গেছে দুয়ার সার্ভিস লিমিটেডের পকেটে।
তৃতীয়পক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে গ্রাহকের সব তথ্য তুলে দেওয়া ও এসএমএস বা মেসেজের মূল্য নিয়ে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো আপত্তি করলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হুমকি দিয়ে গ্রাহকের তথ্য পাঠাতে ও এসএমএসের মূল্য পরিশোধে বাধ্য করা হয়। ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই বিমা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ইউএমপি বাতিলের দাবি জানানো হলেও তাতে কর্ণপাত করছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অবশ্য চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে বিমা কোম্পানিগুলো ইউএমপি সেবার বিপরীতে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
বিমা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোম্পানিগুলো নিজ উদ্যোগে গ্রাহকদের বিমা পলিসি সংক্রান্ত তথ্য জানাতে মোবাইল ফোনে যে এসএমএস দেয়, তার জন্য ব্যয় হয় ৪৪ পয়সা। সেখানে ইউএমপির নামে দুয়ার সার্ভিস দিয়ে যে এসএমএস দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য কোম্পানিগুলো থেকে আদায় করা হচ্ছে ৩ টাকা ৯০ পয়সা করে। অর্থাৎ কয়েকগুণ বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, গ্রাহকদের এসএমএস দেওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনোভাবেই বিমা কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারে না। এটা বিমা আইন-২০১০ এর লঙ্ঘন। বিমা কোম্পানিগুলো শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে একটি সংস্থার ভয় দেখিয়ে এ প্রকল্প চালু করা হয়। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিমা আইন ২০১০ এর কোথাও লেখা নেই আইডিআরএ এ ধরনের সেবার বিনিময়ে কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিতে পারে। এটা সম্পূর্ণভাবে বিমা আইন ২০১০ এর পরিপন্থি। তাছাড়া আমি এসএমএস করতে পারি ৪৪ পয়সায়। তারা (দুয়ার সার্ভিস) আমার কাছ থেকে দুইভাবে অর্থ নিচ্ছে।- প্রগতি লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম
অপরদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইউএমপি গ্রাহকবান্ধব। এটা বন্ধ করা হবে না। বিমা কোম্পানিগুলোর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা করার জন্য ইউএমপি বাতিলের দাবি করছে।
জানা যায়, বিমা কোম্পানির গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ লেনদেনসহ একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরির জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলামকে চিঠি দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছেও পাঠানো হয় সেই চিঠির অনুলিপি।
- আরও পড়ুন
- হোমল্যান্ড লাইফ এখন যেন ‘হায় হায় কোম্পানি’
- সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি তছরুপ, কুদ্দুসের পকেটেই ১৮৪ কোটি টাকা
- জাল শিক্ষা সনদে দুই বিমা কোম্পানির সিইও পদে নিয়োগ চুক্তি
ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর জঙ্গি তৎপরতায় সম্ভাব্য আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও স্বচ্ছতা আনার কথা উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলায় অনেক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যে আর্থিক লেনদেন করে তার কোনো স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কোথায়, কে, কীভাবে এসব অর্থ ব্যয় করছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এবং হিসাব সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
এতে বলা হয়, স্বচ্ছতা ও কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় একদিকে যেমন সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি এই অর্থসন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অর্থ প্রবাহের তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এটা সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে সাহায্য করবে এবং জঙ্গি তৎপরতা দমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইউএমপি নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু ইন্স্যুরেন্স সেক্টরের কতিপয় অসাধু চক্রের কারণে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর আলোকে সব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে একটি স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রীয় ডাটবেজের অধীনে আনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
তখন আইডিআরএর চেয়ারম্যান ছিলেন শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, যিনি একসময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন। তার বিশেষ আগ্রহে এরপর ইউএমপি নামে একটি উদ্যোগ দাঁড় করানো হয়। আর কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র না ডেকেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেওয়া হয় দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে।
প্রথমে দুয়ার সার্ভিসেস লিমেটেড প্রিমিয়াম প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ১০ টাকা করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তা দর-কষাকষি করে পরে ৮ টাকায় নামিয়ে আনে আইডিআরএ। পরবর্তীসময়ে তা আরও কমিয়ে ৩ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর বাইরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই করার জন্যও ১ টাকা করে পাচ্ছে দুয়ার সার্ভিস।
অবশ্য বিমা কোম্পানিগুলো শুরু থেকেই ইউএমপির বিরোধিতা করছে। কিন্তু সে বিরোধিতা আমলে না নিয়েই আইডিআরএর তৎকালীন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী ইউএমপি চালু করতে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। মুস্তফা কামালও তাতে অনুমোদন দেন। অনুমোদনের আগেই এটি চালু হয়। তবে ২০২০ সালের শুরুর দিকেই পুরোদমে চালু হয়ে যায় ইউএমপি।
জীবন বিমা কোম্পানিগুলো যেটার বিরোধিতা করবে, সেটার পক্ষ অবলম্বন করা আমাদের মৌলিক দায়িত্ব। কারণ তারা সব সময় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় পাওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। আমাদের যেসব পদক্ষেপ তাদের অনিয়ম করার বিপক্ষে যায়, সেখানেই তারা শক্ত করে বাতিল করার চেষ্টা করে। ইউএমপি বাতিল হবে না। এটা চলবেই।- আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম
একটি বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, দুয়ার সার্ভিস যে এসএমএসের জন্য ৩ টাকা ৯০ পয়সা করে নিচ্ছে, আমরা নিজ উদ্যোগে যে কোনো মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ৫০ পয়সার কমে সেই এসএমএস পাঠাতে পারতাম। কিন্তু কোনো প্রকার দরপত্র ছাড়েই কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে দুয়ার সার্ভিসকে এ কাজ দেয় আইডিআরএ। ফলে বিমা খাতের মোটা অঙ্কের টাকা ওই প্রতিষ্ঠানটির পকেটে চলে গেছে। একই সঙ্গে গ্রাহকদের তথ্যও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রগতি লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সার্ভিসটা (ইউএমপি) যেভাবে আসছে, তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আসেনি। কারণ সরকারের যে কোনো জিনিস কিনতে গেলে সরকারের ক্রয় নীতিমালা আছে। এই ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী পত্রিকায় দিতে হবে, টেন্ডার করতে হবে এবং কমপক্ষে তিনটি টেন্ডার পাওয়ার পর সেখান থেকে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে কাজ দিতে হয়। কিন্তু এখানে কিছুই করা হয়নি। দুয়ার সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান কোথা থেকে এসে বসে গেছে। এটা নিয়ে তখনই আমরা আপত্তি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ইউএমপি প্ল্যাটফর্মের যে কাজের কথা বলা হচ্ছে, সেই কাজ কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ না। এ কাজ করবে কোম্পানি। যেমন আপনার ব্যাংক হিসাব আছে, আপনি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করলে এসএমএস কে দেয়? এসএমএস দেয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক কি দেয়? বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় না। এখানে (বিমা কোম্পানিতে) একজন গ্রাহক টাকা জমা দিলো, তাকে এসএমএস দেবে কোম্পানি। আইডিআরএ কেন দেবে?’
‘বিমা আইন ২০১০ এর কোথাও লেখা নেই আইডিআরএ এ ধরনের সেবার বিনিময়ে কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিতে পারে। এটা সম্পূর্ণভাবে বিমা আইন ২০১০ এর পরিপন্থি। তাছাড়া আমি এসএমএস করতে পারি ৪৪ পয়সায়। তারা (দুয়ার সার্ভিস) আমার কাছ থেকে দুইভাবে অর্থ নিচ্ছে। একটা নিচ্ছে ৪০ পয়সা এসএমএস দেখিয়ে, আর আমার যতগুলো পলিসি আছে প্রতিটির জন্য ৩ টাকা ৫০ পয়সা চার্জ করছে। অর্থাৎ, যে কাজটা আমি ৪৪ পয়সায় করতে পরি, সেটার জন্য নিচ্ছে ৩ টাকা ৯০ পয়সা।’
জালালুল আজিম বলেন, ‘ধরেই নিলাম এই সার্ভিস ভালো, কিন্তু এর জন্য কেন আমি আট গুণ বেশি টাকা খরচ করবো? যেখানে বেশিরভাগ বিমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি, যার কারণে গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না, সেখানে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিমা খাতের কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে বিআইএ থেকে মোটামুটি মৌখিক নির্দেশনা আছে- আমরা ইউএমপি বাবদ আর কোনো টাকা দেবো না।’
আইডিআরএ থেকে বলা হচ্ছে তারা ইউএমপি চালু রাখবেই। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে এই বিমা নির্বাহী বলেন, ‘যদি তারা চালু রাখার কথা বলেই, বুঝতে হবে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা চালু রাখুক। তাদের বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশের বিমা খাতের উন্নয়নের জন্য ৬৩০ কোটি টাকা দিচ্ছে। সেখানে তারা সফটওয়্যার বানাবে, সফটওয়্যার বানাক। তারা বানিয়ে আমাদের তথ্য নিক। তথ্য নিয়ে আমাদের মনিটরিং করতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় করুক। কিন্তু ইউএমপি বহাল রেখে যদি করতে চায়, তাহলে সোজা কথা আগের ফ্যাসিস্ট সরকারের লোক বসে গেছে ওখানে।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আছে। আমাদের কথা হলো দুদক দেখুক এখানে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না। টেন্ডার ছাড়া দুয়ার সার্ভিস কীভাবে কাজ পেল সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক কি এ ধরনের সেবা দিয়ে ব্যাংকখাত থেকে টাকা নেয়? তাহলে ওনারা (আইডিআরএ) কেন নেবেন? আর ওরা যদি চালু রাখতে চায়, তাহলে ওদের ভেতরও ঘাপলা আছে।’
আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলমের মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জীবন বিমা কোম্পানিগুলো যেটার বিরোধিতা করবে, সেটার পক্ষ অবলম্বন করা আমাদের মৌলিক দায়িত্ব। কারণ তারা সব সময় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় পাওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। আমাদের যেসব পদক্ষেপ তাদের অনিয়ম করার বিপক্ষে যায়, সেখানেই তারা শক্ত করে বাতিল করার চেষ্টা করে। ইউএমপি বাতিল হবে না। এটা চলবেই।’
বিমা কোম্পানিগুলোর পক্ষে থেকে তো বলা হচ্ছে, এতে খরচ বেশি হচ্ছে। এমন কথা বলা হলে আইডিআরএর মুখপাত্র বলেন, ‘তারা যাই বলুক, তাদের বলায় কিছু আসে-যায় না। এটা গ্রাহকবান্ধব। জনবান্ধব একটি বিমাখাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এটা আমাদের অঙ্গীকার।
এমএএস/এএসএ/এএসএম