‘আইপিওহীন’ শেয়ারবাজার

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩০ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশের শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) বড় খরা দেখা দিয়েছে। বিদায়ের পথে থাকা ২০২৪ সালে মাত্র চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে। আগের বছর ২০২৩ সালেও মাত্র চারটি কোম্পানি আইপিওতে আসে। পরপর দুই বছরে এত কম আইপিও স্মরণকালের মধ্যে আর দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিকে আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষক ও বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো কিছু করা যাবে না। কিন্তু পলিসিগত সমস্যার কারণে ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে না। এ কারণে শেয়ারবাজার অনেকটাই আইপিও ছাড়া হয়ে পড়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে বাজারে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

আইপিওতে ধস

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সাল পরপর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও।

২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ এবং টেকনো ড্রাগস। এ চার কোম্পানির মধ্যে এনআরবি ব্যাংক স্থির-মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। বাকি তিনটি কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে এসেছে।

এনআরবি ব্যাংক আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বাকি তিন কোম্পানির মধ্যে বেস্ট হোল্ডিং ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ৯৫ কোটি এবং টেকনো ড্রাগস ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। অর্থাৎ চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে মোট ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।

এর আগে ২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, শিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। অর্থাৎ ২০২৩ সালে তিনটি কোম্পানি এবং একটি মিউচুয়াল ফান্ড আইপিওতে আসে। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা, শিকদার ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। অর্থাৎ চারটি প্রতিষ্ঠানের উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি টাকা।

‘আইপিওহীন’ শেয়ারবাজার

পরপর দুই বছর মাত্র চারটি করে প্রতিষ্ঠান আইপিওতে এলেও ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিলো ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। অবশ্য ২০২২ সালের আগের তথ্য দেখলে শেষ দুই বছরের আইপিওর চিত্র খুবই হতাশাজনক। কারণ ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিলো এক হাজার ৮৫৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকই উত্তোলন করে ৪২৫ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

২০২০ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে নয়টি প্রতিষ্ঠান ৬৫২ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ৪১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৭২ লাখ ২১ হাজার টাকা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করে।

২০১৪ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২৬৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২০৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ২০১১ সালে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৬৭৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ২০১০ সালে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ১৮৬ কোটি আট লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২০০৯ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান ৪৩৫ কোটি আট লাখ ৯৪ হাজার টাকা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করে।

অর্থাৎ গত ১৬ বছরে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে কম আইপিও এসেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের শেষ পাঁচ মাসে কোনো কোম্পানির আইপিও আসেনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি শেয়ারবাজার সংস্কারে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

‘আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার কোনো শেয়ারবাজার নয়। আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো চিন্তা করা যায় না। আমরা মনে করি আইপিওর যে প্রক্রিয়া, সেটি যারা আইপিওতে আসতে চায় তাদের জন্য কমফোর্টেবল (স্বাচ্ছন্দ্য) নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সমস্যা কোথায় সেটা বের করা এবং দ্রুত তার সমাধান করতে হবে।’- ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম

আইপিও কম আসার কারণ

আইপিও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, এক বছরে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের আইপিও আসা স্বাভাবিক নয়। আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য হওয়া আইপিও কম আসার অন্যতম কারণ। এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে পলিসিগত যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের আইপিও ছাড়া একটি শেয়ারবাজার হয়ে গেছে। আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার কোনো শেয়ারবাজার নয়। আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো চিন্তা করা যায় না। আমরা মনে করি আইপিওর যে প্রক্রিয়া, সেটি যারা আইপিওতে আসতে চায় তাদের জন্য কমফোর্টেবল (স্বাচ্ছন্দ্য) নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সমস্যা কোথায় সেটা বের করা এবং দ্রুত তার সমাধান করতে হবে।’

‘আইপিওহীন’ শেয়ারবাজার

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মনে করি আইপিও না আসার দুটি মূল কারণ রয়েছে। এর একটি হলো দাম নির্ধারণ পদ্ধতি ইস্যুয়ার (যে প্রতিষ্ঠান আইপিওতে আসতে চায়) কোম্পানিবান্ধব নয়। আরেকটি হলো আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। আইপিও প্রসেসিংয়ে লম্বা সময় লাগে। এ দুটি কারণ দ্রুত সমাধান করা দরকার। ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে কী চায়, সেটা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে হবে। আইপিওতে আসতে ওনাদের কী কী অসুবিধা হচ্ছে, সেটা বের করতে হবে এবং তার সমাধান করতে হবে।’

ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে হবে ইনসেনটিভ দিয়ে

ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, অতীতে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে ওপর মহল থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি। একটা বিষয়ে এখানে কোনো ইনসেনটিভ নেই। তাহলে ভালো কোম্পানি আসবে কেন? এটা নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, ওরা এটা দেখবে।

তিনি বলেন, আইপিও কম আসার আর একটি কারণ ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ নেওয়া যায়। আমাদের মতো অর্থনীতির দেশে ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে হবে ইনসেনটিভ দিয়ে। ওপর মহল থেকে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসতে হবে। তারা কী চায়, সেটা জানতে হবে। কিছু ইনসেনটিভ দিয়ে তাদের সমস্যা দূর করতে হবে। এটা তো আগে করা হয়নি কখনো। এ কারণে ভালো কোম্পানির আইপিও আসছে না।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে ভালো কোম্পানির আগ্রহী না হওয়া একটি বড় সমস্যা। অতীতে বিএসইসি যেভাবে ছিল এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যেভাবে ব্যবস্থাপনা করা হতো, এখানে একটা চক্র আছে, ওই চক্রের মধ্যে না ঢুকলে আইপিওতে শেয়ার ইস্যু করা যেত না। কাজেই এখানে সুশাসনের একটা বড় সমস্যা আছে। যার কারণে আস্থার সংকট আছে। শেয়ারবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য এখন সরকার একটা কমিটি করেছে। তারা কিছু সুপারিশ দিয়ে এই চক্রগুলো ভেঙে দিতে হবে।

এমএএস/এমএএইচ/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।