অর্থপাচারকারীরা নিজেরাই পাচার হয়ে গেছে

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১০ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

‘রেমিট্যান্সের প্রবাহে যে উন্নতি, আমার মনে হয় এটার বড় কারণ হুন্ডির বাজারে মন্দা যাচ্ছে। কারণ অর্থপাচার যারা করতেন তারা নিজেরাই পাচার হয়ে গেছেন। যারা পাচার হননি, তারা দেশে আত্মগোপনে আছেন। এখন তো ওদের ওই সুযোগ (অর্থপাচার করা) নেই।’

কথাগুলো বলছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে, সেখানে সদস্য হিসেবে রয়েছেন তিনি।

দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং নতুন বছর ২০২৫ সালের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ড. জাহিদ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার পাশাপাশি কীভাবে বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব জানিয়েছেন সেই উপায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন

জাগো নিউজ: আগামী বছর অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?

জাহিদ হোসেন: এই প্রশ্নের ছোট উত্তর- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আগামী বছর তো অনেক ধরনের প্রত্যাশা আছে। কেউ কেউ বলছেন- আগামী বছর নির্বাচন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- রাজনৈতিক সংস্কার, যেগুলো সবাই বলছেন। কিছু মৌলিক সংস্কার করে তারপর নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা সম্ভব। এর আগে একটা রোডম্যাপ হয়তো তারা দেবে জানুয়ারিতে। কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যেমন- আজকের পত্রিকায় (১৪ ডিসেম্বর) গতকাল (১৩ ডিসেম্বর) বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে রাজনৈতিক দলকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। এগুলোতে স্থিতিশীলতা রাখতে সহায়ক হবে না। এ ধরনের যদি মতবিরোধ থাকে এবং এগুলো যদি আরও গভীর হয়…।

আগামী বছরের মূল চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ।

একটা পরিষ্কার পথের নকশা কেউ সামনে যদি দেখতে না পারে, তাহলে আমাদের এক্সপোর্টের (রপ্তানি) যারা ক্রেতা আছে, আমাদের বাণিজ্যে যারা ঋণ দেয় এবং দেশের বিনিয়োগকারীরা যাদের বিনিয়োগের আগ্রহ আছে, দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায় বা সরাসরি বিনিয়োগ করতে চায় তারা তো ভরসা পাবে না। অর্থনীতি থেমে থাকে না। বিষয়টি হলো এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটা বড় সমস্যা। এটা এভাবে চললে তো মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে এবং সেটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো হবে না। সেটার সুযোগ নেবে অনেকে।

আপনার পেটে ক্ষুধা থাকলে কেউ ডাক দিলেই রাস্তায় নেমে পড়বে। কারণ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কিছু একটা তো করতে হবে। এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো হয়ে গেছে। অর্থনীতি যদি সচল রাখা যায় এবং কর্মকাণ্ডগুলো ঠিকমতো চলে তাহলে মূল্যস্ফীতি একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে না এলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। আবার সেটা হলে অর্থনীতি সচল হবে না। মানে একটা চক্রের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এখন শুরুটা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থেকে।

জাগো নিউজ: মূল্যস্ফীতি কমানো বড় চ্যালেঞ্জ হবে কি?

জাহিদ হোসেন: আগামী বছরের মূল চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি গত দুই মাসে কমেছে কিছুটা। খানিকটা কমেছে অত উল্লেখযোগ্য না, তবে বাড়েনি। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো ১৪-এর কাছাকাছি চলে গেছে। দরিদ্র মানুষের জন্য জীবিকার সংকট এটা। সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় পুরোনো কৌশলগুলো চালিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

জাগো নিউজ: পুরোনো কৌশল বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

জাহিদ হোসেন: পুরোনো কৌশল মানে পুলিশি কায়দায় বাজার ব্যবস্থাপনা করা, এটা থেকে আমরা কখনো সুফল পাইনি। যেখানে পুলিশি কায়দায় পদক্ষেপ দরকার, সেটা হলো চাঁদাবাজি বন্ধের ক্ষেত্রে। ওটাও মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে। ওই জায়গায় আপনি পুলিশি অ্যাপ্রোচ নেন। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে গিয়ে ছোট ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের ডান্ডাবাজি করে, ওদের জরিমানা করে.., বাজার কারসাজিতে তো ওদের ওই সক্ষমতা নেই।

দাম বাড়লে নতুন খেলোয়াড়রা বাজারে ঢুকতে আগ্রহী হয়, কারণ সেখানে লাভ পাওয়া যায়। কিন্তু ঢুকতেই যদি ছয় মাস কেটে যায়, সরকার থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টেশন ক্লিয়ার করতে, তাহলে ওই খেলা তো সম্ভব নয়।

বাজার ব্যবস্থাপনায় যে পর্যায়ে সমস্যা আছে- তা হলো পাইকারি পর্যায়ে এবং আড়তদার-মিলার পর্যায়ে। হোলসেল লেভেল বা স্টক যেখানে করছে বা মিলার পর্যায়ে, আমদানি পর্যায়ে বড় বড় যারা খেলোয়াড় আছে তারা জোটবদ্ধ হয়ে মাঝে মধ্যে কারসাজি করে বাজার উঠিয়ে দেয় (দাম বাড়িয়ে দেওয়া), আর সরবরাহ ভালো থাকলেও দাম কমতে দেয় না। এখানে প্রতিযোগিতার পথ মসৃণ করতে হবে।

জাগো নিউজ: প্রতিযোগিতার পথ মসৃণ কীভাবে করা সম্ভব?

জাহিদ হোসেন: দাম বাড়লে নতুন খেলোয়াড়রা বাজারে ঢুকতে আগ্রহী হয়, কারণ সেখানে লাভ পাওয়া যায়। কিন্তু ঢুকতেই যদি ছয় মাস কেটে যায়, সরকার থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টেশন ক্লিয়ার করতে, তাহলে ওই খেলা তো সম্ভব নয়। প্রতিযোগিতার পথ মসৃণ করা মানে বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। কোন বাজারে কী পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে, কত দামে লেনদেন হচ্ছে, গুদামে কত আছে এই তথ্যগুলো একটা প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত তুলে ধরতে হবে। আইনি ব্যত্যয় ঘটলে আইন প্রয়োগ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাগো নিউজ: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে তো বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের কষ্ট বাড়বে।

জাহিদ হোসেন: মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করা যেত যদি আপনার আয় বাড়তো। ভালো কর্মসংস্থান যদি সৃষ্টি না হয়, তাহলে তরুণদের বেকারত্ব থেকে যাবে। বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য নতুন বিনিয়োগ দরকার এবং সেটা কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনিয়োগ। আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিনিয়োগ দেখেছি, কিন্তু কর্মসংস্থান দেখিনি। যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নতুন বিনিয়োগ আসবে। পলিসি ঠিক থাকলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনিয়োগই হবে।

জাগো নিউজ: আগামী বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ থাকবে কি না?

জাহিদ হোসেন: রিজার্ভে গত দু-তিন মাসে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। রেমিট্যান্সের বৃদ্ধিটা বেশ ভালোই, ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এখন তো মাসে ২২০ কোটি ডলার- এটাই একটা স্বাভাবিক লেভেল (পর্যায়) হয়ে গেছে রেমিট্যান্সের। তার সঙ্গে সঙ্গে এক্সপোর্টের যে টাকাগুলো ধরে রাখতো, সেই ধরে রাখার প্রবণতা কমেছে। তারপরও একেবারে স্বস্তি চলে এসেছে তা নয়। রেমিট্যান্সের প্রবাহে যে উন্নতি, আমার মনে হয় এটার বড় কারণ হুন্ডির বাজারে মন্দা যাচ্ছে। কারণ অর্থপাচার যারা করতেন তারা নিজেরাই পাচার হয়ে গেছেন। আর যারা পাচার হননি, তারা দেশে আত্মগোপনে আছেন। এখন তো ওদের ওই সুযোগ (অর্থপাচার করা) নেই।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগ এমনিতেই আসবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ করতে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা সহজ করতে হবে।

আবার নতুন পাচারকারীরা যাতে আসতে না পারে, সেজন্য পাচারের পথগুলো বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল এবং দুর্নীতি দমন কমিশন যদি আরও সচল হয় এবং ওখানে যদি আমরা সরিষার মধ্যে ভূত তাড়াতে পারি তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি ফিরে আসবে।

জাগো নিউজ: সামনে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কি?

জাহিদ হোসেন: এখনো তো নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ক্রেতারা কনফিডেন্স (আস্থা) পান না, আপনি ডেলিভারি (সরবরাহ) দিতে পারবেন কি না সময়মতো। ওই কনফিডেন্স না পাওয়ার প্রধান কারণ ওরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছে। কী ঘটবে না ঘটবে। হঠাৎ করে রাস্তা-ঘাট, বন্দর চলবে কি না। এজন্যই বলছিলাম প্রধান চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটা মূল্যস্ফীতি বলেন, রেমিট্যান্স বলেন, অর্থপাচার বলেন বা রপ্তানি সব ক্ষেত্রে কিন্তু এটা (রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা) একটা বড় বিষয়।

জাগো নিউজ: বিনিয়োগের জন্য সুদের হার কমানো উচিত কি না?

জাহিদ হোসেন: সুদের হারের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। সুদের হার তো ৯ শতাংশে ফিক্সড ছিল চার বছর, তখন কি আমরা ভালো বিনিয়োগ দেখেছি? দেখিনি। তাহলে আসল বাধাগুলো তো সেখানে নয়। সুদের হার বেশি, এটা ব্যবসায়ীরা অপছন্দ করবেন সেটা স্বাভাবিক। কারণ সুদের হার কমালে তাদের টাকা-পয়সা কম খরচ হবে। তার মানে এই নয় যে তারা বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগের পথে বাধাগুলো কাঠামোগত বাধা।

জাগো নিউজ: বিনিয়োগ বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

জাহিদ হোসেন: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগ এমনিতেই আসবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ করতে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা সহজ করতে হবে। নতুন বিনিয়োগে রেজিস্ট্রেশন লাগবে, বিডা-তে যেতে হবে, এনবিআরে যেতে হবে, বিদ্যুতের সংযোগ লাগতে পারে- এই যে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে হয় এবং বিভিন্ন ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়, শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগে, পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিয়ারেন্স লাগে- এই প্রক্রিয়ায় কিন্তু প্রচুর সময় যায় এবং জটিল। এখানে অনেক ঝঞ্ঝাট আছে। ওগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

এমএএস/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।