বিএমডব্লিউর শুল্ক ফাঁকি খুঁজতে বেরিয়ে এলো আরও জালিয়াতি

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৮:২৬ এএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৪
শুল্ক ফাঁকি দিতে নানান ধরনের জাল-জালিয়াতি করেন আমদানিকারক/ছবি- জাগো নিউজ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দেশে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহার। তবে এসব গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিতে তথ্যে অসঙ্গতি ও নানান ধরনের জাল-জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধে শুধু আমদানিকারকই নয়, ক্রেতাদের প্রতারণার তথ্য মিলছে হরহামেশা।

সম্প্রতি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের ‘চট্টমেট্রো-গ-১৪-১৭৪৫’ নম্বরের গাড়িটি আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা। এরপরই ওই গাড়ি আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি ও অর্থপাচারের ঘটনা আলোচনায় আসে। জানা যায়, আমদানির সময় গাড়ির মডেল, তৈরির সালসহ সবকিছুই জালিয়াতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ঠিক কত টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি তা নিশ্চিত করতে পারেনি কাস্টমস।

গাড়িটি আমদানি করে চট্টগ্রামের নাগোয়া করপোরেশন। ২০২০ সালের ৩ মে ব্র্যান্ড নিউ বিএমডব্লিউ প্রাইভেট কারটি খালাস নেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। খালাসের সময় গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৫ সিরিজের ‘৫৩০-ই’ মডেলের ঘোষণা দেওয়া হয়। মূলত গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৭ সিরিজের ‘৭৪০-ই’ মডেলের। উৎপাদন হয় ২০১৭ সালে। তবে আমদানির সময় উৎপাদন সাল দেখানো হয় ২০১৯।

কী বলছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মিনজাহ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাড়িটি চার বছর আগে খালাস নেওয়া। কম ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি বাদেও বেশ কয়েক ধরনের জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে গাড়িটি উৎপাদন হলেও ২০১৯ সালের উৎপাদন দেখিয়ে তা আমদানি করা হয়।’

আমদানি নথিতে গাড়িটির দাম ২০ হাজার মার্কিন ডলার ঘোষণা দেওয়া হয়। শুল্কায়ন করা হয় ৪০ হাজার মার্কিন ডলার দেখিয়ে। অথচ গাড়িটির মূল্য এক লাখ ডলারের মতো ছিল।

তিনি বলেন, ‘গাড়িটি আমদানি হয় নাগোয়া করপোরেশন নামের চট্টগ্রামের এক গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে। কিন্তু গাড়িটি বিক্রি করে এলএনবি অটোমোবাইলস। এটি কেনেন অনুপ বিশ্বাস নামের চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী। আমদানি নথিতে গাড়িটির দাম ২০ হাজার মার্কিন ডলার ঘোষণা দেওয়া হয়। শুল্কায়ন করা হয় ৪০ হাজার মার্কিন ডলার দেখিয়ে। অথচ গাড়িটির মূল্য এক লাখ ডলারের মতো ছিল। এতে গাড়িটির মূল্য অন্তত ৬০ হাজার ডলার কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।’

বিএমডব্লিউর শুল্ক ফাঁকি খুঁজতে বেরিয়ে এলো আরও জালিয়াতিসম্প্রতি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের গাড়িটি আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা/ ছবি- জাগো নিউজ

কাস্টমসের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গাড়িটি ৫৩ লাখ টাকা শুল্ক দিয়ে খালাস নেওয়া হয়। এটি যেহেতু ২০১৭ সালের তৈরি, কিন্তু খালাসের সময় ২০১৯ সালের তৈরি উল্লেখ করে শুল্কায়ন হয়েছে। সেক্ষেত্রে জব্দ গাড়িটি হয়তো আমরা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবো। পরে কাস্টমস আইন অনুযায়ী নিলামে বিক্রি করা হবে।’

গাড়িটির বর্তমান বাজারমূল্য দুই কোটি টাকার বেশি জানিয়ে মিনজাহ উদ্দিন বলেন, ‘গাড়িটি ১২ থেকে ১৪ দিন আগে চৌধুরী ফ্যাশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয়।’

আমদানির তথ্য অস্বীকার নাগোয়া করপোরেশনের

গাড়িটি নাগোয়া করপোরেশন আমদানি করেনি বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাকিব চৌধুরী। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘গাড়িটি যখন আমদানি করা হয় তখন আমি ছাত্র ছিলাম। এলএনবি অটোমোবাইলস আমাদের পরিচিত। সরলতার সুযোগে কাগজে আমার সই নিয়ে গাড়িটি এলএনবি অটোমোবাইল আমদানি করে। ওই গাড়ির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

এ বিষয়ে এলএনবি অটোমোবাইলসের স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় আমাদের শো-রুম রয়েছে। আমি ঢাকায় বসি। বিএমডব্লিউ গাড়িটি বিক্রি হয়েছিল আমাদের চট্টগ্রাম শো-রুম থেকে। ঘটনাটি চার-পাঁচ বছর আগের। এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আমাদের কয়েকজন ম্যানেজার পরিবর্তন হয়েছে। গাড়িটির বিষয়ে বিস্তারিত জেনে তারপর বলতে হবে। শুনেছি গাড়িটি কাস্টমস আটক করেছে। কিন্তু কাস্টমস আমাদের কাছ থেকে লিখিত কিছু জানতে চায়নি।’

তিনি বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি গাড়িটি নাগোয়া করপোরেশন আমদানি করেছিল। আমরা অন্য আমদানিকারকদের কাছ থেকে নিয়েও গাড়ি বিক্রি করি।’

রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের যত সদস্য রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানির সঙ্গে জড়িত। ব্র্যান্ডনিউ গাড়ি আমদানি করেন হাতেগোনা দু-একজন। আগের উৎপাদন হলেও আমদানির সাল বাড়িয়ে দেখালে বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়। কারণ এতে ক্রেতারা মনে করেন গাড়িটি লেটেস্ট। এতে বিক্রেতা বেশি লাভবান হন।’

বিএমডব্লিউর শুল্ক ফাঁকি খুঁজতে বেরিয়ে এলো আরও জালিয়াতিসম্প্রতি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের গাড়িটি আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা/ ছবি- জাগো নিউজ

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমস গোয়েন্দাদের হাতে আটক ‘চট্টমেট্রো-গ-১৪-১৭৪৫’ নম্বরের গাড়িটি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ২৮ ইকবাল রোড ফিশারিঘাটের ঠিকানায় অনুপ বিশ্বাসের নামে নিবন্ধিত। ২০১৯ মডেলের গাড়িটি ২০২২ সালে বিআরটিএতে নিবন্ধিত হয়। প্রাইভেটকারটির ফিটনেসের মেয়াদ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ রয়েছে।

মারা গেছেন ‘গাড়ির মালিক’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাড়িটি অনুপ বিশ্বাস নামে যে ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত তিনি গত ২৩ আগস্ট মারা যান। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। অভিযোগটি অনুসন্ধান করছিলেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম এবং আবদুল মালেক। এ দুই কর্মকর্তা বদলির পর অন্য আরেক কর্মকর্তাকে বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তবে মাদক বিক্রির জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স রয়েছে অনুপ বিশ্বাসের। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোংয়ের তালিকাভুক্ত বিপণকারী তিনি। নগরীর ফিশারিঘাটে তার মদ বিক্রির পারিবারিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমস গোয়েন্দাদের হাতে আটক গাড়িটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আয়কর নথিতে দেখিয়েছেন অনুপ বিশ্বাস। আয়কর নথিতে ‘চট্টমেট্রো-ঘ-১১-২১৯৫’ নম্বরের আরেক গাড়ি মিলিয়ে দুই গাড়ির মূল্য দেখানো হয় দুই কোটি ২১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

এলএনবি অটোমোবাইলস আমাদের পরিচিত। সরলতার সুযোগে কাগজে আমার সই নিয়ে গাড়িটি এলএনবি অটোমোবাইল আমদানি করে। - নাগোয়া করপোরেশনের মালিক সাকিব চৌধুরী

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনুপ বিশ্বাসের নামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানকালে তার ফাইলের স্তূপ পড়েছে। এখন যেহেতু তিনি মারা গেছেন, সেহেতু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

আটকের পর যা জানিয়েছিল কাস্টমস গোয়েন্দা

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আমদানি করা গাড়িটির দলিল যাচাই করে দেখা গেছে, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের দেওয়ান হাট এলাকার নাগোয়া করপোরেশন গাড়িটি আমদানি করে। ২০২০ সালের ৩ মে ব্র্যান্ড নিউ বিএমডব্লিউ প্রাইভেট কারটি খালাস নেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। খালাসের সময় গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৫ সিরিজের ‘৫৩০-ই’ মডেলের ঘোষণা দেওয়া হয়। মূলত গাড়িটি বিএমডব্লিউ-৭ সিরিজের ‘৭৪০-ই’ মডেলের।

গত ১৩ নভেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকার মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপে সার্ভিসিংয়ের সময় গাড়িটি আটক করা হয়। পরে গাড়িটি কাস্টমস হাউজ ঢাকার শুল্ক গুদামে জমা দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা।

বিএমডব্লিউর শুল্ক ফাঁকি খুঁজতে বেরিয়ে এলো আরও জালিয়াতিসম্প্রতি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের গাড়িটি আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা/ ছবি- জাগো নিউজ

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘আমদানি করা গাড়িটি মিথ্যা ঘোষণায় দলিলাদি জালিয়াতি করে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাস্টমস আইন-২০২৩ এর সেকশন ১৮, ৩৩, ৯০, ১২৬ এর আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাশাপাশি একই আইনের ২(২৪) ধারা অনুসারে চোরাচালান হিসেবে গণ্য হওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।’

কথা হয় মেসার্স মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. ইসমাইল করিম চৌধুরীর সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘কাস্টমস গোয়েন্দারা বুধবার বিকেলে বিএমডব্লিউ কারটি আটক করে। গাড়িটি আমাদের কাছে সার্ভিসিং করতে আনা হয়। কাজটি (সার্ভিসিং) চৌধুরী ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডের নামে বুকিং ছিল।’

যদিও গাড়িটি কেনার কথা অস্বীকার করেছেন চৌধুরী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিক চৌধুরী। চৌধুরী ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড চট্টগ্রামভিত্তিক চৌধুরী গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায়। রফিক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএমডব্লিউ গাড়িটি আমরা এখনো কিনিনি। কেনার জন্য দেখেছিলাম।’

এমডিআইএইচ/কেএসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।