জর্ডানেই ‘আটকা’ বোয়েসেলের শ্রমবাজার

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৬ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করতে পারছে না বোয়েসেল/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

• নতুন শ্রমবাজার খুলছে না
• জি টু জি পলিসিতে লোক পাঠানো হচ্ছে
• দক্ষ করেই লোক পাঠানোর আশ্বাস

দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)। জনশক্তি রপ্তানির জন্য ১৯৮৪ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত এক যুগের বেশি সময় সংস্থাটি নতুন বড় কোনো শ্রমবাজার তৈরি করতে পারেনি। ঘুরেফিরে সিংহভাগ জনশক্তি রপ্তানি করেছে জর্ডানে।

বোয়েসেল থেকে জর্ডান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, কুয়েত, মরিশাস, হংকং, ফিজিসহ ৩২টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো হয়। সবশেষ যুক্ত হয়ছে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ব্রুনেই। অন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।

বোয়েসেল থেকে ক্রমাগত জর্ডান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশি লোক পাঠানো হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিতে অবদান রাখতে পারছে না। একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও।

বোয়েসেলের মাধ্যমে মাত্র কয়েকটি দেশেই লোক যাচ্ছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার খুলছে কম। বোয়েসেল যদি বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক পাঠায়, এতে শ্রমবাজারে খুব বেশি যে অবদান রাখে এটা আমি মনে করি না। তবে এখানে প্রতারণা নেই।- বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন শরিফুল হাসান

সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোয়েসেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ১৫ হাজার ৫৫৮ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৫০২ জন কর্মী পাঠিয়েছে জর্ডানে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩০১৯, ফিজিতে ১২৫, লেবাননে ৫২ ও রোমানিয়ায় পাঠিয়েছে ৩৯ জন।

এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে যান ১৫ হাজার ২৯৪ জন কর্মী। গত বছরও সবচেয়ে বেশি ৬ হাজার ৯৭৮ লোক পাঠানো হয় জর্ডানে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬ হাজার ৭৪৯ জন, মালয়েশিয়ায় ৭৫৪ জন ও কুয়েতে পাঠানো হয় ৫৭৮ জনকে।

গত ১৪ বছরে বোয়েসেলের মাধ্যমে যাওয়া কর্মী

গত দুই বছরের তুলনায় আগের অর্থবছরগুলোতে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা ছিল কিছুটা কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে বোয়েসেলের মাধ্যমে ১৮ হাজার ২৫৪ জন কর্মী বিদেশ যান, ২০২০-২১ অর্থবছরে যান ৫ হাজার ৫৫৬ জন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ৫২৫ জন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ হাজার ৫১৭ জন ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ হাজার ৩৩ জন কর্মী।

জর্ডানেই ‘আটকা’ বোয়েসেলের শ্রমবাজার

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু গত ১০ বছরে দেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন ৭৭ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১ জন। সবশেষ ২০২৩-২৩ অর্থবছরে গেছেন ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৩ জন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গেছে ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন।

অন্যদিকে গত ১৪ বছরে (২০১০-২০২৪) মাত্র ১ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫ জন কর্মী পাঠিয়েছে বোয়েসেল। এর মধ্যে জর্ডানে ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৩, দক্ষিণ কোরিয়া ৩১ হাজার ৩৭, বাহরাইন ১ হাজার ৫৩৬, কুয়েত ৬৭৭, ফিজি ১৫৫, রাশিয়া ৩৭, লেবানন ২, বুলগেরিয়া ৫২, জাপান ২৮, রোমানিয়া ১৯৭, ক্রোয়েশিয়া ১৭, হংকং ১৫, সিশেলস ৪১, বতসোয়ানা ১, মরিশাস ১০৭, মালদ্বীপ ৯৮, মিশর ১৪৮, কাতার ১৬২, আরব আমিরাত ৩৬, ওমান ১ হাজার ৯১, রোমানিয়া ১৯৭, ক্রোয়েশিয়া ১৭ ও মালয়েশিয়ায় ১ হাজার ৫২০ জন।

নতুন নতুন শ্রমবাজার খোলা কিংবা চাহিদা নেওয়ার কাজ মন্ত্রণালয়েরও। তাই এখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের শ্রমবাজার খোলার দায়িত্ব দিতে হবে। তারা সংখ্যার দিক থেকে কম পাঠাতে পারে। কিন্তু দক্ষ লোক ও কম টাকার মধ্যে যদি পাঠাতে পারে, এটা আবার ভালো দিক।- অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির

জানা যায়, বোয়েসেলের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ছিল জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো, শ্রমবাজার বিস্তার ও শ্রমিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি এজেন্সিগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা। তবে এসব ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি বোয়েসেল।

যা বলছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোয়েসেলের মাধ্যমে মাত্র কয়েকটি দেশেই লোক যাচ্ছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার খুলছে কম। বোয়েসেল যদি বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক পাঠায়, এতে শ্রমবাজারে খুব বেশি যে অবদান রাখে এটা আমি মনে করি না। তবে এখানে প্রতারণা নেই। কর্মীরা ভালো কাজ করে। মোটামুটি ভালো স্যালারি পায় এটা সত্য।’

‘বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিতে অধিক লাভের একটা টার্গেট থাকে। বোয়েসেলের উদ্দেশ্য কিন্তু সেটি নয়। বোয়েসেলের যে পরিমাণ গতি নিয়ে কাজ করার কথা, আমি মনে করি সেটা হচ্ছে না। যেখানে প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ লোক কর্মী বিদেশ যায়, সেখানে বোয়েসেল পাঠাচ্ছে মাত্র ১৫ হাজার। আমি মনে করি বোয়েসেল থেকে কমপক্ষে এক লাখ লোক পাঠানো উচিত।’

শরিফুল হাসান বলেন, ‘প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে বিএমইটি বা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে, এদের থেকে বেশির ভাগ লোক বিদেশ যেতে পারে না। অন্যদিকে বোয়েসেল আবার দক্ষ লোক পায় না। এখানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বোয়েসেল যদি টিটিসিকে গাইড করে তাহলে দক্ষ কর্মী বের করে আনতে পারবে। তাহলে সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যাও বাড়বে।’

জর্ডানে লোক যায় আমাদের জি টু জি পলিসিতে। তারা শুধু বোয়েসেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়। অন্য কোনো এজেন্সি জর্ডানে লোক পাঠায় না। বাংলাদেশে গার্মেন্টসকর্মীর সংখ্যা বেশি, ফলে নারীদের আগ্রহ বেশি। জর্ডানেরও চাহিদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে বাংলাদেশি কর্মীর প্রতি। ফলে বাজার সমৃদ্ধ হচ্ছে।- বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক মো. শওকত আলী

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোয়েসেল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে না। আমি মনে করি নতুন নতুন শ্রমবাজার খোলা কিংবা চাহিদা নেওয়ার কাজ মন্ত্রণালয়েরও। তাই এখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের শ্রমবাজার খোলার দায়িত্ব দিতে হবে। তারা সংখ্যার দিক থেকে কম পাঠাতে পারে। কিন্তু দক্ষ লোক ও কম টাকার মধ্যে যদি পাঠাতে পারে, এটা আবার ভালো দিক।’

জর্ডানেই ‘আটকা’ বোয়েসেলের শ্রমবাজার

তিনি বলেন, ‘বোয়েসেলকে দক্ষ করতে হবে। বোয়েসেলের কর্মকর্তাদের শ্রমবাজার তৈরির জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে, দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। বোয়েসেলকে খুঁজতে হবে, বিদেশিরা কোন ধরনের শ্রমিক চাচ্ছে, কোন দক্ষতা দরকার, কী পরিমাণ লোক যাবে। তাহলে তারা সেভাবে আবেদন গ্রহণ করবে। এই দায়িত্বটুকু বোয়েসেলকে দিতে হবে।’

বোয়েসেলের বক্তব্য

সার্বিক বিষয়ে বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ২ হাজার ২৬২ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। বোয়েসেলকে এদের সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এই প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের বাজার সম্প্রসারণে অনেক ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, কিন্তু বোয়েসেল নিতে পারে না। আমরা যদি কোনো মার্কেটে ঢুকি তখন আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায় বাকি ২ হাজার ২৬২ এজেন্সি। তাই আমরা কম লোক পাঠাতে পারি। প্রতি বছর ১৫ হাজার যাচ্ছে। আশা করছি এটা বাড়বে। তবে আমরা অন্য এজেন্সির তুলনায় খুবই কম টাকা নেই।’

জর্ডানকেন্দ্রিক শ্রমবাজার বিষয়ে শওকত আলী বলেন, ‘জর্ডানে লোক যায় আমাদের জি টু জি পলিসিতে। তারা শুধু বোয়েসেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়। অন্য কোনো এজেন্সি জর্ডানে লোক পাঠায় না। আমাদের মাধ্যমে অল্প কিছু পুরুষ ছাড়া প্রায় সব নারী যাচ্ছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টসকর্মীর সংখ্যা বেশি, ফলে নারীদের আগ্রহ বেশি। জর্ডানেরও চাহিদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে বাংলাদেশি কর্মীর প্রতি। ফলে বাজার সমৃদ্ধ হচ্ছে।’

সৌদিতে বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের এজেন্সির সঙ্গে সৌদির কোম্পানিগুলোর আগে থেকে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তারা বাংলাদেশে এলে কোম্পানিগুলো অনেক সুবিধা দেয়, এখানে তারা টাকাও বেশি দেয়। ফলে সৌদিতে ঢোকা আমাদের জন্য একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’

শওকত আলী বলেন, ‘বছরে ১৫ হাজার কর্মী যাচ্ছে, এতে আমরাও সন্তুষ্ট না। আমরা চাচ্ছি কমপক্ষে প্রতি বছর ৩০ হাজারের বেশি মানুষ যাক। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে আমরা সেটা পারছি না। আমাদের কিছু লোকবল সংকট রয়েছে।’

‘আমরা দক্ষ কর্মী পাচ্ছি না। বোয়েসেলে যারা আসে, অনেকে ম্যাট্রিক পাসও না, দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষা, জাপানিজ ভাষা শিখতেও ন্যূনতম বাংলা ও ইংরেজি জানা লাগে। সেজন্য এসব দেশে বেশি লোক পাঠাতে পারছি না। আমাদের চেষ্টা থাকে সব সময়ই দক্ষ করে লোক পাঠানো, যাতে কর্মীদের সেখানে বিড়ম্বনায় না পড়তে হয়।’

ইউরোপে শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ইউরোপের শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করছি। ইতালি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে গত বছর একটা এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) পাঠিয়েছি। যদিও এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ২৭টি দেশে শ্রম কল্যাণ উইং আছে। তারাও বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করছে।’

আরএএস/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।