কাটেনি মন্দা, থমকে আছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর দুই মাসেও পুরোপুরি গতি ফেরেনি ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়। রাজধানীসহ সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজার এখনো চলছে ঢিলেঢালা। রয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। বিপণন ব্যবস্থায় আছে ঘাটতি। এ অবস্থায় বিক্রি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরপরই বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, আগুন, ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। একটি বড় অংশের মানুষের আয় কমেছে। কাজ হারিয়েছেন কেউ কেউ, কাজ হারানোর আতঙ্কে আছেন বহু কর্মী। তারা বিভিন্ন খাতে খরচ কমিয়েছেন। যার প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে রপ্তানির বাইরে অন্য পণ্যের পরিবহন ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। এখনো সারাদেশে পণ্য পৌঁছাতে পারছেন না নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। এতে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানার গুদামে পণ্য জমছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন। ফলে কমছে আমদানিও।
সাধারণ ক্রেতারা পণ্য একদম কম কিনছেন। যে কারণে বিক্রেতারাও কোম্পানিগুলোর কাছে পণ্য কেনা কমিয়েছে। যার যতটুকু দরকার তার চেয়েও কম কিনে চালিয়ে নিচ্ছে। কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন- সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা
চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা ৪০ শতাংশের মতো কমেছে। এখন যেসব পণ্য দেশে আসছে, এগুলো বিদেশ থেকে তিন-চারমাস আগে কেনা। কিন্তু সেগুলো এনে বিক্রি করা যাচ্ছে না। জমে যাচ্ছে। আবার এলসি খোলা কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব আবার সামনে পড়বে। সব মিলিয়ে ব্যবসা নিজ গতিতে নেই।’
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহ আন্দোলন-পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়েই কেটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বড় ব্যবসায়ীরাও অনেকে ছন্নছাড়া। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তে আবার হানা দিলো ভয়াবহ বন্যা। সব মিলিয়ে দুই মাস কেটে গেলেও স্থিতিশীলতা আসছে না দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে।
- আরও পড়ুন
- দ্রুত বর্ধমান ভোগ্যপণ্যের বাজারে মন্দা
- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-আগুন, শঙ্কায় কর্মীরা
- বন্যায় মাছ-কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি, পুনর্বাসনের চেষ্টায় সরকার
- স্থিতি আসেনি ব্যবসা-বাণিজ্যে
নিত্যপণ্যের বাজারে বড় একটি কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ততটা ভালো হয়নি। বেশ কিছু সময় ধরে আন্দোলনের পর দেশে বড় বন্যা হলো। ব্যবসায়ীরা এখন কঠিন সময় পার করছেন। পণ্যের বিক্রি ও চাহিদা কমে গেছে।’
ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে রয়েছে এখনো। ট্যুরিজম-হোটেল-রেস্তোরাঁ কোনো কিছুতে মন্দা কাটেনি। মানুষ এখনো ঘর থেকে বের হচ্ছে না সেভাবে। বিদেশিরাও নেই এখন দেশে। এসব পরিস্থিতি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।- মেঘনা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার
তিনি বলেন, ‘সাধারণ ক্রেতারা পণ্য একদম কম কিনছেন। যে কারণে বিক্রেতারাও কোম্পানিগুলোর কাছে পণ্য কেনা কমিয়েছেন। যার যতটুকু দরকার তার চেয়েও কম কিনে চালিয়ে নিচ্ছেন। কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এছাড়া ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন। অনেক এলাকায় এখনো ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন।’
দেশে ছাত্র আন্দোলন শুরুর আগেও ভোগাচ্ছিল গ্যাস সংকট। এসব সংকট কিছুটা কাটিয়ে উৎপাদনে ফিরেছে কারখানাগুলো। তবে আগের গতানুগতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু নতুন সমস্যা।
দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানার উৎপাদন শুরু হলেও আমদানি হওয়া কাঁচামাল আসা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কাঁচামাল সংকট রয়েছে। এছাড়া বিক্রি কমে যাওয়া, ডলারের ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকখাতে অস্থিতিশীলতা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের অভাবের কারণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তারা।
ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা তোলা যাচ্ছে। এ কারণে লেনদেন একদম কমে গেছে। কেউ বড় লটে পণ্য কিনছে না। পাইকারি কারবার এখনো ২০ শতাংশ হচ্ছে না। এর মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি আরও বিপদে ফেলেছে।- বাংলাদেশ পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির আহম্মেদ
চলমান পরিস্থিতিতে নানা ধরনের সমস্যার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলছেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে দেশে বেশ কিছু শিল্পগ্রুপের কারখানা এখন বন্ধ। সেসব কোম্পানির পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে।
এছাড়া পর্যটন, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ অন্য খাতের মন্দার প্রভাব ভোগ্যপণ্যের বাজারে পড়ছে জানিয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে রয়েছে এখনো। ট্যুরিজম-হোটেল-রেস্তোরাঁ কোনো কিছুতে মন্দা কাটেনি। মানুষ এখনো ঘর থেকে বের হচ্ছে না সেভাবে। বিদেশিরাও নেই এখন দেশে। এসব পরিস্থিতি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সবকিছু স্বাভাবিক না হলে ব্যবসা স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব নয়।’
আবার যেসব কোম্পানি স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পণ্য সরবরাহকারী অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মালিকও বিগত সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হওয়ায় এখনো তারা ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। ফলে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে কিছু কোম্পানির। সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিবেশকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারাও তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন না।
ভোগ্যপণ্যের বাজারে একটি বড় কোম্পানি এস আলম গ্রুপ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে এস আলমের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের পণ্যের সরবরাহ নেই বাজারে।
মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি মো. আলী ভুট্টো জাগো নিউজকে বলেন, ‘এস আলম বাজারে নেই। এটা একটি সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা এখন। তেলের সরবরাহ কম, বিক্রিও কম।’
বাংলাদেশ পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা তোলা যাচ্ছে। এ কারণে লেনদেন একদম কমে গেছে। কেউ বড় লটে পণ্য কিনছে না। পাইকারি কারবার এখনো ২০ শতাংশ হচ্ছে না। এর মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি আরও বিপদে ফেলেছে।’
এনএইচ/এএসএ/এমএমএআর/এএসএম