ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে অস্থিরতার নেপথ্যে

ইয়াসির আরাফাত রিপন
ইয়াসির আরাফাত রিপন ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত: ০৪:১৩ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অস্থিরতা চলছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনে। অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনে নতুন কমিটি গঠনেরও দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে কিছু সংগঠনে পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ব্যবসায়ী নেতাদের ক্ষোভের মূলে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচনে কারচুপি, ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটগ্রহণ ও বলপ্রয়োগ করে প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা দাবি তুলছেন নেতৃত্ব পরিবর্তনের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দলীয় ব্যানারে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বে এসে ব্যবসায়ীর স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছেন নেতারা। এ অবস্থায় এই নেতাদের পরিবর্তে ব্যবসায়ী মহলের সমস্যা সমাধানে নতুন নেতা নির্বাচন করতে চান তারা।

সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হলে সেই নেতা সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এতে সংগঠন যেমন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়ারও সমাধান হয়।- এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি

তবে এর মাঝেও ব্যতিক্রম রয়েছে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠন, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। যেখানে কোনো সিলেকশন ছিল না। বিভেদও নেই তাদের নিজেদের মধ্যে। ব্যবসায়ীদের উন্নয়নে এই সংগঠনগুলো কাজ করে চলছে। এসব সংগঠনের মধ্যে অ্যাগ্রো ফুডের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) উল্লেখযোগ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা য়ায়, অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের মাঝে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কয়েকদিন হট্টগোল হওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এস এম মান্নান কচি। সংগঠনটিতে নতুন সভাপতি মনোনীত হয়েছেন ডিজাইনটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম। এছাড়া সংগঠনটির আরও কিছু পদে পরিবর্তন এসেছে। যদিও এখনো আন্দোলন চলছে পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে।

বর্তমানে নিজের শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমি ই-ক্যাব সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি এবং তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগপত্রটি কার্যকর করার অনুরোধ করছি।- শমী কায়সার

বিজিএমইএর সাধারণ সদস্যদের পক্ষে অনন্ত গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু জাগো নিউজকে বলেন, এ সংগঠনটি (বিজিএমইএ) দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বার্থান্বেষী ও স্বৈরাচারী শাসকের কতিপয় ব্যক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। গত ৯ মার্চ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ক্ষমতায় আসে, যা সাধারণ সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

বাপার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ঐক্য পরিষদবাপার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ঐক্য পরিষদ

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) থেকে পদত্যাগ করেন মোহাম্মদ আলী খোকন। সংস্থাটির সাবেক সহ-সভাপতি ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেল নতুন সভাপতি হয়েছেন। গত ১১ আগস্ট ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ ছাড়েন মোহাম্মদ আলী খোকন। বিটিএমএতে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

নির্বাচনের মাধ্যমে জয় পেলে সেই নেতৃত্ব অ্যাসোসিয়েশনের জন্য কাজ করে, সংগঠনকে বুঝতে পারে। কিন্তু বিনা ভোটে নেতৃত্ব এলে সেটা হয় না।- রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া

এছাড়া দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই–ক্যাব) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন শমী কায়সার। গত ১৪ আগস্ট সংগঠনের প্যাডে ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিষদ বরাবর লেখা চিঠির মাধ্যমে তিনি পদত্যাগ করেন।

পদত্যাগপত্রে শমী কায়সার উল্লেখ করেন, বর্তমানে নিজের শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমি ই-ক্যাব সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি এবং তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগপত্রটি কার্যকর করার অনুরোধ করছি। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কার্যপরিচালনা চলমান রাখার জন্য আমার অবর্তমানে বর্তমান ইসি (ই-ক্যাবের নির্বাহী কমিটি) দায়িত্ব পালন করবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) এ সমস্যা চলছে বেশকিছু দিন ধরে। গত ৫ আগস্ট দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এফবিসিসিআই ঘিরে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসে। এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি জানিয়ে গত ১৮ আগস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দেন এফবিসিসিআইয়ের কয়েক জন ব্যবসায়ী। কমিটি ভেঙে দেওয়ার জন্য মানববন্ধনও করা হয়।

রিহ্যাব নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদরিহ্যাব নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ

তবে এফবিসিসিআইয়ের এ কমিটি সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সমঝোতার পথ বন্ধ করে সরকার প্রশাসক বসিয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর এফবিসিসিআইয়ে মো. হাফিজুর রহমান ও ই-ক্যাবে মোহাম্মদ সাঈদ আলীকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মহাপরিচালক বাণিজ্য সংগঠন) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরীর সই করা আদেশে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, নিয়োগকৃত প্রশাসক ১২০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।

সিলেকশন না করে ইলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচন করে নজির স্থাপন করেছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এবং বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বাপা ২০২৩-২৫ মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ঐক্য পরিষদ পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়েছে। ঐক্য পরিষদ ও সর্বজনীন ব্যবসায়ী পরিষদে দুটি প্যানেলের ১৫ জন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এছাড়া দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন। যেখানে ভোট বা নেতা নির্বাচন নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ক্ষোভ তৈরি হয়নি।

একই চিত্র দেখা যায় আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব নির্বাচনেও। এ সংগঠনের নির্বাচন নিয়েও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যদিও একটি পক্ষ প্রায় এক যুগ নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। রিহ্যাব পরিচালনা পর্ষদের অন্যায় কার্যক্রমের প্রতিবাদ করায় তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন তাদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন সময় অনেককে বহিষ্কারও করে। দীর্ঘদিন পর রিহ্যাবে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরাসরি ভোটারদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচন হচ্ছিল না এ সংগঠনে।

রিহ্যাব সদস্যরা বলেন, রিহ্যাবে গণতান্ত্রিকভাবে যে নির্বাচন শুরু হলো তা সংগঠনকে ব্যবসায়ী মহলে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরছে। তারা বলেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হওয়ায় সদস্যদের পক্ষে কাজ করছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। তারা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।

ই-ক্যাব সভাপতির পদ ছাড়েন শমী কায়সারই-ক্যাব সভাপতির পদ ছাড়েন শমী কায়সার

এ বিষয়ে রিহ্যাবের সাধারণ সদস্যরা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করি। একজন প্রশাসকের অধীনে নির্বাচন হয়, যেখানে সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে জয় পেলে সেই নেতৃত্ব অ্যাসোসিয়েশনের জন্য কাজ করে, সংগঠনকে বুঝতে পারে। কিন্তু বিনা ভোটে নেতৃত্ব এলে সেটা হয় না।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি আবুল কাশেম হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসায়ীদের এপেক্স বডি এফবিসিসিআই, যেখানে ব্যবসায়ীদের সমান সুযোগ থাকবে। ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে কাজ করবে সংগঠন, কিন্তু এতদিন সেটা হয়নি। সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সদস্যদের মতামত নেওয়া হতো না। এ কারণে এফবিসিসিআই পর্ষদের পদত্যাগ চেয়েছিলাম। একই সঙ্গে দাবি ছিল বর্তমান পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগের।

‘সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হলে সেই নেতা সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এতে সংগঠন যেমন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়ারও সমাধান হয়’- যোগ করেন তিনি।

ইএআর/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।