আর্থিকখাত সংস্কারের কাজটাও অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরু করতে হবে

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে মধ্য জুলাই থেকে দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনে রোববার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে দেশে দ্রুত স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইব্রাহীম হুসাইন অভী ও সাইফুল মিঠু

জাগো নিউজ: অনেকটা অচলাবস্থা বিরাজ করছে দেশের অর্থনীতিতে। অর্থনীতি স্বাভাবিক করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে।

জাহিদ হোসেন: প্রথম কাজ হলো অর্থনীতি স্বাভাবিক সচ্ছলতার মধ্যে নিয়ে আসা। অফিস-আদালত সব খুলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও খুলছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ঠিকমতো চলতে পারে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে কী পারবে না সেটা নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। সেই নির্বাচন করে দেওয়া। সেখানে এই সরকার কত সময় পাবে, ৬ মাস বা ১২ মাস…। ২০০৭-২০০৮ সালে আমরা দেখেছি। এখানে তো অনেক কাজ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন তো শুধু বললেই হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক অনেক সংস্কারের ব্যাপার আছে।

আমাদের আগের আইনে ফিরে যেতে হবে। গত কয়েক বছরে দুদকের ভেতরেই প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরিষার মধ্যে ভূতটা তো তাড়াতে হবে। দুদক আইনের সংস্কার প্রয়োজন।

অর্থনীতি তো বসে থাকে না। আমাদের অর্থনীতি আগেই চাপে ছিল। বড় কিছু বিষফোঁড়া ছিল। এই দুর্যোগের ফলে সেগুলো আরও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভ স্বল্পতা, আর্থিকখাতে দুর্দশা, জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি এসব সমস্যা ছিল।

জাগো নিউজ: প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কেন প্রয়োজন হবে? দুর্নীতি, অদক্ষতা, দলীয়করণ- এগুলোর কারণে কী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার প্রয়োজন? এ সংস্কার কে করবে?

জাহিদ হোসেন: এ পরিবর্তনটা ঘটলো ছাত্রদের শক্তিতে। ছাত্রদের আন্দোলনের এ পরিবর্তনটা তো এলো। ছাত্ররা বলেছে, এই পরিবর্তনটা কেবল একটা ধাপ মাত্র। তাদের আন্দোলন এখনো পূর্ণতা পায়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বে এটা প্রথম স্টেজ। এখন দ্বিতীয় স্টেজে ছাত্ররা দেশে সুশাসন স্থাপন করতে চায়। ছাত্ররা আগের পলিটিক্যাল মডেলে ফিরে যেতে চায় না।

ফ্যাসিবাদী রেজিম থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চায় ছাত্ররা। এটা তাদের প্রধান লক্ষ্য। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে ছাত্রদেরও সুনির্দিষ্ট মতামত আছে। দুর্নীতি নির্মূল ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা তাদের প্রধানতম অগ্রাধিকার বলে মনে হলো। ছাত্রদের কথা আমরা উপেক্ষা করতে পারবো না।

ছাত্ররা একটা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে যে আরেকটা নির্বাচন করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। সংস্কারের জন্য তো বসে থাকা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের অংশ হিসেবেও দুর্নীতি দমন করা জরুরি। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে না।

নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার দরকার। গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যিনি সরকারপ্রধান তিনিই একজনকে বেছে নেন। নিয়োগের শর্ত পালন করে, প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এ নিয়োগ হওয়া উচিত।

পুলিশ, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, আর্থিকপ্রতিষ্ঠান- এগুলোর সুশাসনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া যদি শুরু না হয়, তাহলে আস্থা ফিরে আসবে না। রাতারাতি দুর্নীতি রোধ করা যাবে না। এটা এত সোজা কাজ নয়। তবে কাজটা সঠিকভাবে শুরু করতে হবে। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ২০০৭-২০০৮ এ দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য অভিযানগুলো আমরা দেখেছি।

সে সময় দুদককে দেখেছি তারা অনেক রাঘববোয়ালকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে। সেটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেখানে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল। সাধারণ মানুষ এ উদ্যোগে খুশি ছিল। কিন্তু পরে দেখা গেলো সবাই বেরিয়ে গেছে। এটার শিক্ষা আমাদের নিতে হবে।

সংস্থাটির অনেক তাড়াহুড়া ও কিছু একটা করে দেখানোর বিষয় ছিল। এজন্য কোনো প্রস্তুতি ছাড়া কোর্টে মামলা করে দিলো। কিন্তু সেগুলো তো আর টিকলো না। লিগ্যাল প্রিপারেশনের অভাব ছিল। ভালো কোনো আইনজীবীও তখন দুদকে ছিল না।

জাগো নিউজ: দুদক কী শিক্ষা নিতে পারে?

জাহিদ হোসেন: ২০০৭-২০০৮ এর ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি দমন আইন করেছিল। তখন সবাই বলেছে আইনটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়েছে। ওটা প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারের মধ্যে জারি করা হলো। তারপরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে এটা সংসদে পাস করলো। পরে এতগুলো সংশোধনী আনা হলো যে আইনটার সব বাতিল হয়ে গেলো। তখন আইনটা দুর্নীতিবাজদের পক্ষে চলে গেলো। দুর্নীতি দমন কমিশনের হাত-পা বেঁধে রাখা হলো।

আমাদের আগের আইনে ফিরে যেতে হবে। গত কয়েক বছরে দুদকের ভেতরেই প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরিষার মধ্যে ভূতটা তো তাড়াতে হবে। দুদক আইনের সংস্কার প্রয়োজন। দুদককে পুনঃগঠন করতে হবে। বর্তমানে অনেকেই সেখানে আছেন যারা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। দুদককে ঠিক করে দিলে তারা অটো পাইলটে চলে যাবে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবে। দুর্নীতি রোধে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে জনগণ ও ছাত্র যারা এত রক্ত দিলো এরা ভীষণভাবে হতাশ হবে। সেটার পরিণতি ভালো নয়।

জাগো নিউজ: ব্যাংকিং, আর্থিকখাতসহ অনেক কিছুর ওপর দুর্নীতির কালো থাবা আছে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে আপনার পরামর্শ কী?

জাহিদ হোসেন: আর্থিকখাত দুর্দশাগ্রস্ত। এক প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। আর্থিকখাতে কিছু ম্যাক্রো প্রবলেম আছে। তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতির সমস্যা, খেলাপি ঝণের সমস্যা। যেসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির কালো থাবা পড়েছে সেগুলোর সবগুলোই এখন দুর্দশাগ্রস্ত। আর্থিকখাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ও যাদের সবচেয়ে বেশি সুনাম ছিল সেটি ইসলামী ব্যাংক। সেটার অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিদিনই তাদের টাকা ধার করতে হচ্ছে।

আর্থিকখাতের সংস্কারের কাজটাও অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরু করতে হবে। অর্থনীতি আর থেমে থাকতে পারে না। শুধু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা পূর্বশর্ত; তারপরে কী? অর্থনীতির বিষফোঁড়া যেগুলো আছে সেগুলোর চিকিৎসা তো শুরু করতে হবে। না হলে এই ফোঁড়া আরও বাড়তে থাকবে। সাম্প্রতিক আন্দোলনে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে ক্ষত ছিল তা আরও গভীর হয়েছে।

দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা সমাধানে কিছু কার্যক্রম এরই মধ্যে ঘোষিত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন ঘোষণা করেছে গত বছর। এটা তারা করেছিল দাতা সংস্থার কাছ থেকে টাকা খাওয়ার জন্য। ওই সার্কুলারে সুষ্পষ্ট কিছু পদক্ষেপের কথা বলা আছে। কোন প্রতিষ্ঠান কী ক্যাটাগরিতে পড়বে। তাদের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে এটা বলা আছে। কিন্তু সেখানে ডিলেয়িং ট্যাকটিক্যাল ছিল, যে আমরা এটা করবো না। অনেই অজুহাত দেখিয়ে ওইটা ২০২৫ এর মার্চের পর বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। পরিকল্পনা ভালো। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নের আলো দেখেনি। এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এগিয়ে আনতে হবে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদটা কী সব সময় বাইরে থেকে আসবে? যদি ব্যাংকের ভেতরের লোক ডেপুটি গভর্নর হতে পারে, তাহলে তিনি কেন গভর্নর হতে পারবেন না?

জাহিদ হোসেন: এখানে একটা প্রতিযোগিতামূলক সিস্টেম করা উচিত। এ ধরনের নিয়োগ প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে হয়। যেখানে ভেতর ও বাইরের দুই ধরনের লোকই অ্যাপ্লাই করতে পারে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার দরকার। গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যিনি সরকারপ্রধান তিনিই একজনকে বেছে নেন। নিয়োগের শর্ত পালন করে, প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এ নিয়োগ হওয়া উচিত। কোনো প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন দেখতে চাইলে সে ধরনের স্ট্যাটাস তো তাকে দিতে হবে। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে গড়তে হলে, সেখানে কিছু সংস্কারের প্রয়োজন আছে।

আইএইচও/এসএম/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।