প্রত্যাশার ‘বারুদ’ শেয়ারবাজারে

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৬ এএম, ১০ আগস্ট ২০২৪
শেয়ারবাজারে খুশির জোয়ার

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শেয়ারবাজার যেন প্রত্যাশার ‘বারুদ’ ছড়াচ্ছে। তাতেই হু হু করে বাড়ছে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম। মূল্যসূচকে হচ্ছে উল্লম্ফন। লেনদেনও বাড়ছে তরতরিয়ে। মাত্র তিনদিনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক প্রায় ৭০০ পয়েন্ট বেড়ে গেছে। দুইশ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন ১ হাজার ৬শ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের শেয়ারবাজারে সুশাসন ছিল না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানাভাবে বাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে। তাতে আরও বেড়েছে বাজারের সংকট। একই সঙ্গে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখন সরকার পতনের পর সবকিছু নতুন করে সাজানো হচ্ছে। তাতে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে এবং বাজার ভালো হবে সেই প্রত্যাশা বিনিয়োগকারীদের মনে জেগেছে। তারই প্রতিফলন এখন বাজারে।

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বাজার পতনের মধ্যে থাকায় ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ। একই সঙ্গে লেনদেনের গতি বাড়ছে। এতে বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাজারে বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় এবং নতুন বিনিয়োগ আসছে। বাজারে এখন সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অযাচিত হস্তক্ষেপ।

সরকার পরিবর্তন হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তারা প্রত্যাশা করছেন দেশ ও শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। বাজারে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে। সেই প্রত্যাশায় নতুন আশা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন।- ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৩ মার্চ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৬ হাজার ২১৫ পয়েন্ট। আর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এরপর শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের মধ্যে পড়লে ১১ জুন ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৫ হাজার ৭০ পয়েন্টে নেমে যায়। আর বাজার মূলধন কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, অব্যাহত দরপতনের মধ্যে পড়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমে ১ হাজার ১৪৫ পয়েন্ট এবং বাজার মূলধন কমে ১ কোটি ২৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা।

প্রয় তিনমাস ধরে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন হলেও গত ঈদের পর শেয়ারবাজারে টানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ঈদের পর ৯ জুলাই লেনদেন হওয়া ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে ১২ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী দেখা মিলেছে। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৪৬৭ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৫৯৪ পয়েন্টে উঠে আসে। আর বাজার মূলধন ৪০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়।

আরও পড়ুন

এরপর শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে শেয়ারবাজারে আবার দরতপন প্রবণতা দেখা দেয়। আন্দোলন ঘিরে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হলে অব্যাহত পতনের মধ্যে পড়ে ৪ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্টে নেমে আসে। লেনদেন কমে দুইশ কোটি টাকার ঘরে নেমে যায়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আগেও নানা ইস্যুতে শেয়ারবাজারে মন্দা চলছিল। যে কারণে বাজারের পতন ঠেকাতে শেয়ার দাম কমার নিয়মে পরিবর্তন আনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নিয়ম করা হয় কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম একদিনে ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। সূচকের পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আরও চিড় ধরায়। ফলে পতনের মধ্যেই থাকে বাজার।

আমার যেটা মনে হয় সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে বাজার একটা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। যেহেতু নতুন সরকার আসছে এবং তারা নতুনভাবে সাজাবে জিনিসগুলো, সেজন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা হাই (বেড়ে যাওয়া) হয়েছে।- ডিবিএর সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী

তবে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলনের মুখে পড়ে গত সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরই মধ্যে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরের কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর এখনো পর্যন্ত তিন কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এই তিন কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে ৬৯৫ পয়েন্ট।

এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস দেশে ফেরার দিন বৃহস্পতিবারই ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৩০৬ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক হিসেবে যাত্রা শুরু করে ডিএসইএক্স। এরপর একদিনে সূচকটির এত বড় উত্থান আর কখনো হয়নি। ডিএসইএক্স সূচক রেকর্ড লাফ দেওয়ার পাশাপাশি লেনদেন বেড়ে ১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা হয়েছে।

বাজারের এই চিত্র সম্পর্কে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, গত কয়েক বছরে ধরে শেয়ারবাজারে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিভিন্ন সময় অযাচিত হস্তক্ষেপ করে কারসাজিকারীদের শেয়ারবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কারসাজিকারীদের সুযোগ করে দিতেই ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা) বেঁধে দিয়ে দীর্ঘদিন বাজার আটকে রাখা হয়। বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার কারণে এক পর্যায়ে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলেও পরবর্তীসময়ে দাম কমার ক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। এটিও কারসাজিকারীদের সুযোগ কেরে দিতে করা হয়। ফলে বাজারের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে শেয়ারবাজার পতনের মধ্যে পড়ে। এখন সরকার পতন হওয়ায় শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশা করছেন বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। একই সঙ্গে ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আসবে। সেই আশায় বিনিয়োগকারীরা বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। ফলে দীর্ঘ মন্দা কেটে বাজার সুদিনে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ডিএসইর আরেক সদস্য বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা একদিকে দুর্বল কোম্পানিকে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ করে দিয়েছে, অন্যদিকে নানা নিয়ম করে কারসাজিকারীদের অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ফলে বাজারের ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, এখন যেহেতু সরকার পতন হয়েছে, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ঢেলে সাজানো হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে বিনিয়োগকারীরা এই প্রত্যাশায় আছেন। বিনিয়োগকারীদের এ প্রত্যাশার কারণেই বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজারে সক্রিয় হচ্ছেন। ফলে ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ছে। এটা খুবই ইতিবাচক।

একটি ব্রোকারেজ হাউজে লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হচ্ছেন। গত দুদিন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এরই মধ্যে তারা কিছু নতুন বিনিয়োগও করেছে। অথচ কিছুদিন আগে বাজারে বিদেশিদের বেশি বিক্রির চাপ ছিল।

ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তন হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা করছেন দেশ ও শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। বাজারে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে। সেই প্রত্যাশায় নতুন আশা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন। মৌলভিত্তি সম্পন্ন ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এটা শেয়ারবাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক।’

ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার যেটা মনে হয়- সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে বাজার একটা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। যেহেতু নতুন সরকার আসছে এবং তারা নতুনভাবে সাজাবে জিনিসগুলো, সেজন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা হাই (বেড়ে যাওয়া) হয়েছে। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দামও বাড়ছে।’

বাজারে সুশাসন ফেরানো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু প্রতিটি জায়গায় পরিবর্তন আসছে কিংবা আসবে সেটার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। কী পরিবর্তন আসে তারপর বলা যাবে সুশাসনের কী হলো। আমরা তো অবশ্যই সুশাসন চাই। সবকিছু ভালো হবে দেখতে চাই। প্রত্যেকটা ইনস্টিটিউশনে সুশাসন চাই।’

এমএএস/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।