সংসারের ঘানি টানাই দায়
ঢাকার শাহাজাহানপুর এলাকায় চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী এনামুল হোসেন। চলতি বছরের শুরুতে বেতন বেড়েছে সামান্য। সে তুলনায় খরচ বেড়েছে ঢের বেশি। বাসাভাড়া থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, কাঁচাবাজার, সন্তানের লেখাপড়া খরচ- বাড়েনি এমন কোনো খাত নেই। সংসারের ঘানি টেনে গ্রামে বাবা-মাকেও টাকা পাঠাতে পারছেন না এনামুল।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাজার খরচ। আগে মাসের বাজার ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে হতো। এখন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে। এছাড়া সাবান-পেস্টের মতো আইটেমগুলোতে আগের চেয়ে ৫-৬শ টাকা বেশি লাগছে। গত বছরের চেয়ে বাসাভাড়া বেড়েছে এক হাজার টাকা। বিদ্যুৎ-গ্যাস ডিশ, পানির বিল বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৭-৮শ টাকা।’
পাশাপাশি অফিস যাওয়া-আসা খরচ ৫শ টাকা, দুই ছেলে-মেয়ের গৃহশিক্ষকের বেতন ১ হাজার টাকা বাড়াতে হয়েছে এনামুলের। ৬শ টাকা বেড়েছে গৃহকর্মীর বেতনও। ছেলে-মেয়েদের স্কুলের বেতন, মোবাইল বিল ও ইন্টারনেট খরচও বেড়েছে প্রায় হাজার টাকা।
প্রকৃত মূল্যস্ফীতি এরচেয়েও বেশি। আবার পণ্যের দাম সরকার যেমন বলে তারচেয়েও বেশি। এ পরিস্থিতিতে মানুষ খরচ কুলাতে পারছে না। যাদের রয়েছে, তারা সঞ্চয় ভাঙছে। যাদের সেটা নেই, তারা বাধ্য হয়ে কম খাচ্ছে।- সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
এনামুল বলেন, ‘সংসারের খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকায় ঠেকেছে, যা বেতনের চেয়েও বেশি। ফলে এখন সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। গ্রামে মা-বাবাকে আগে প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতাম, সেটাও পারছি না।’
এনামুলের মতো অবস্থা অধিকাংশ মানুষের। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি নেই ব্যয়ের। মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে ঘাড়ে। গত এক-দেড় সপ্তাহে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ।
রাজধানীর রামপুরা এলাকায় দুই কক্ষের একটি বাসায় থাকেন ফিরোজা বেগম। স্বামীহারা এ নারীর দুই সন্তান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘সব খাতেই ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু গত বছর ইনক্রিমেন্ট হয়েছে দেড় হাজার টাকা। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর হয়ে পড়ছে। মাসে ব্যয় বেড়েছে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা।’
- আরও পড়ুন
- কিছু মানুষ চক্রান্ত করে দ্রব্যমূল্য বাড়াচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
- বৃষ্টি-বন্যার কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি সাময়িক: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
বাড়তি ব্যয় সামাল দিচ্ছেন কীভাবে- এমন প্রশ্নের জবারে ফিরোজা বলেন, ‘খাওয়া-দাওয়া খারাপ হচ্ছে। অফিস থেকে হেঁটে ফিরছি। বাচ্চারাও হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। বাড়তি কোনো পোশাকও কিনছি না।’
মানুষের ব্যয় বাড়ছে। বিকল্প আয়ের কোনো পথ নেই। অপরদিকে বড়লোকদের আয় বাড়ছে, যেহেতু প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ফলে সেটা বড়লোকদের মধ্যে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘসময় আয় বৈষম্য বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।- ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান
রাজধানীর বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে গত কয়েকদিন কথা বলে জানা যায়, একটি পরিবারে স্থিরব্যয় বেড়েছে মূলত বাসাভাড়া, সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাবদ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সার্বিক খরচেও একটি বড় প্রভাব ফেলেছে।
সেগুনবাগিচা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল হক বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দামের কারণে কম টাকায় রিকশায় যাওয়া যায় না। এলাকায় গৃহকর্মীদের মজুরি এক কাজের জন্য ১২শ টাকা ছিল। এখন ১৫শ টাকা হয়েছে।’
কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা জানান, ডিশ সংযোগ ফি, ইন্টারনেট ফি, এমনকি ময়লা ফেলার জন্যও বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে।
খরচের বিষয়ে পাকা হিসাব রাখেন খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা কাওসার হোসেন। সেটা দেখিয়ে বলেন, ‘আগে বিদ্যুৎ মিটারে ৮শ টাকা রিচার্জ করতাম, এখন ১ হাজার টাকা রিচার্জ করলেও মাস যায় না। গ্যাসের সিলিন্ডার গত বছর ১২শ টাকা ছিল, এখন ১৪শ ৫০ টাকা নেয়। বাড়িওয়ালা আগে পানির বিল নিতেন না, এখন বিল বাবদ ৬শ টাকা নিচ্ছেন, কারণ তারও খরচ বেড়েছে। ডিশ সংযোগ ও ইন্টারনেটে বিল বেড়েছে ২০০ টাকা।’
- আরও পড়ুন
- ‘ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে’
- তিনদিনে ৩০ টাকা বেড়ে পেঁয়াজের কেজি ১৩০
- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই
তিনি বলেন, ‘এবার বাজার খরচে আসুন। একবছরে বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫-৭শ টাকা। কোনো ভালো মাছ কেজিপ্রতি ৪-৫শ টাকার নিচে মেলে না। ৮০ টাকা কেজির নিচে এখন সবজি পাওয়া যায় না। পেঁয়াজের কেজি ১৩০ টাকা, আদা-রসুন ৩শ টাকা। আলু ৬০ টাকা দরে কিনছি। পেস্ট, সাবান, চিনি, তেল, লবণ সবকিছুর দামই বাড়তি। এতে গত বছরের চেয়ে চলতি জুলাইয়ে এসে বাজার খরচ বেড়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।’
বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ
এসব মানুষের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি। গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চিত্র দেখা গেছে এবার। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশিমক ৭৩ শতাংশ। আরও খারাপ পরিস্থিতি খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। অথচ বিদায়ী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ছিল সরকারের।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি বাড়লেও বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বাড়ছে না কর্মসংস্থানের পরিধিও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার।
কোভিডের সময় বিশ্বের অনেক দেশে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তখন নয়-ছয় নীতি করে তা আটকে রাখা হয়। আবার ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অজুহাতে সরকার টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে। এসব ভুল নীতির কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।- আহসান এইচ মনসুর
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকৃত মূল্যস্ফীতি এরচেয়েও বেশি। আবার পণ্যের দাম সরকার যেমন বলে তারচেয়েও বেশি। এ পরিস্থিতিতে মানুষ খরচ কুলাতে পারছে না। যাদের রয়েছে, তারা সঞ্চয় ভাঙছে। যাদের সেটা নেই, তারা বাধ্য হয়ে কম খাচ্ছে। প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কমিয়ে দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।’
অতিরিক্ত খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন কাজ
হাতিরঝিলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ছোট চাকরি করি। বিকেলে অফিস শেষে চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বের হচ্ছি। রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত এ কাজ করি। এতে প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা থাকে। উপায় নেই। বাড়তি কিছু না করলে সংসার চলবে না।
নিত্যপণ্য কিনতেই নাজেহাল
সবচেয়ে বড় সমস্যা নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম। চাল, ডিম আলুসহ বাজারে অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দর বাড়তি। মধ্যম মানের চাল ৬০ টাকা, আলু ৬০-৬৫ ও পেঁয়াজ ১২০ টাকা। ৮০ টাকার নিচে মিলছে না সবজি। একবছর আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৬০-৭০ টাকা, আলু ৪০ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজারদরের প্রতিবেদনও বলছে জিনিসিপত্রের দাম বাড়ছে। সংস্থাটির হিসাবে, এক বছরে চালের দাম ৭ শতাংশ বেড়েছে। ডালের দাম বেড়েছে মানভেদে ৫০ শতাংশ, পেঁয়াজ ১৫০ শতাংশ। আদা, রসুন, হলুদ মরিচ গুঁড়া প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মাছ, মাংস ডিম ও দুধের দামও বেড়েছে এ সময়।
টিসিবি যেসব পণ্যের দামের হিসাব রাখে প্রায় অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। এ সংস্থা হিসাবের বাইরে রয়েছে সবজির দাম। তবে সেখানেও নেই স্বস্তি। বরবটি, বেগুন, করলার দাম শুনলেই হতবাক হচ্ছেন অনেক ক্রেতা। এসব সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগ সবজির কেজি ৮০ টাকার বেশি।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের ব্যয় বাড়ছে। বিকল্প আয়ের কোনো পথ নেই। অপরদিকে বড়লোকদের আয় বাড়ছে, যেহেতু প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ফলে সেটা বড়লোকদের মধ্যে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘসময় আয় বৈষম্য বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।’
তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে পুষ্টিহীনতা বাড়ছে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে। কারণ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা ঠিকমতো খেতে পারছেন না। তাদের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা বড় প্রভাব ফেলবে। এই শ্রেণির আয় বাড়ানোর পথ খুলতে হবে। লাগাম টানতে হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির।’
গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার কিছু সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়। প্রকৃত সুবিধাভোগীদের নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অর্থাৎ ওএমএস, টিসিবি যাদের প্রয়োজন তারা সবাই পাচ্ছে না।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোভিডের সময় বিশ্বের অনেক দেশে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তখন নয়-ছয় নীতি করে তা আটকে রাখা হয়। আবার ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অজুহাতে সরকার টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে। এসব ভুল নীতির কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তবে বেড়ে যাওয়া পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব হবে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধি অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সেজন্য নতুন করে টাকা ছাপানো যাবে না। ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতে হবে।’
এনএইচ/এএসএ/জিকেএস