ঋণে আটকা লাভেলো যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩৫ পিএম, ১৪ জুলাই ২০২৪

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৮৫ কোটি টাকা। ঋণ আছে একশ কোটি টাকার বেশি। ঋণে আটকে থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্প্রতি হু হু করে বেড়েছে। এ দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

এরপরও দামের পাগলা ঘোড়া থামছে না। ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে আড়াইশ শতাংশ। লাভেলোর শেয়ার যেন এখন রূপকথার আলাদিনের চেরাগ।

প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের এমন দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, লাভেলো আইসক্রিমের আর্থিক ভিত্তি খুব একটা শক্তিশালী নয়। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি কখনো বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি। অথচ কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্প্রতি হু হু করে বেড়েছে। এই দাম বাড়ার প্রবণতা দেখলে সহজেই বোঝা যায় কারসাজির মাধ্যমে কোনো বিশেষ চক্র এটা বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা উচিত। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ারের বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।

একশ কোটি টাকা ঋণ এটার জন্য তেমন কিছু না। আমাদের টার্নওভার প্রায় একশ কোটি টাকা। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের ঋণ বাড়েনি বললেই চলে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।- লাভেলো আইসক্রিমের কোম্পানি সচিব মোহিউদ্দিন সরকার

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৯ জানুয়ারি লাভেলো আইসক্রিমের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২৯ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে এখন ১০৪ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৭৪ টাকা ২০ পয়সা বা ২৪৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী গত ২৯ জানুয়ারি লাভেলো আইসক্রিমের ১০ লাখ টাকার শেয়ার কেনেন, তাহলে এখন তার বাজারমূল্য ৩৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৩২ টাকা। এ হিসাবে ১০ লাখ টাকা খাটিয়ে ছয় মাসেই মুনাফা পাওয়া গেছে ২৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকার বেশি।

শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি সম্প্রতি ২০২৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ২৮ পয়সা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ পয়সা বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে গরমে আইসক্রিম বিক্রি বাড়ার কারণে মুনাফা বেড়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।

এদিকে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিক্রি হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আগের বছরের একই সময়ে বিক্রি হয় ২৪ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নয় মাসে কোম্পানিটির বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল ৭৪ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

যদি কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম হঠাৎ বড় আকারে বেড়ে যায়, তাহলে সার্ভিলেন্স থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হয়। যদি লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো ম্যানুপুলেশন বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম

চলতি বছরের তিন মাসে বিক্রি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও কোম্পানির খরচ সেই হারে বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নয় মাসে কোম্পানিটির প্রশাসনিক খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে এই খরচ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রশাসনিক খরচ বেড়েছে ২ লাখ টাকার কম।

২০২৩-২৪ হিসাব বছরের নয় মাসে বাজারজাত ও বিক্রির খরচ হয়েছে ৯ কোটি ৮০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে এ খরচ ছিল ৯ কোটি ৪২ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগের হিসাব বছরের তুলনায় এ খাতে খরচ বেড়েছে ৩৮ লাখ টাকার মতো।

প্রশাসনিক ও বিক্রির ব্যয় খুব একটা না বাড়লেও কোম্পানিটির সুদজনিত ব্যয় বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নয় মাসে সুদজনিত ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ১৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে এই ব্যয় ছিল ৮ কোটি ৫৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

সুদের পিছনে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণ কোম্পানিটির বিপুল পরিমাণ ঋণ রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ কোটি ৩৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এছাড়া লিজ আছে ২৩ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের জুন শেষে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৬৮ কোটি ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা এবং লিজ ছিল ২২ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।

এদিকে চলতি বছরের মার্চ শেষে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কারেন্ট পোরশন দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যা গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। আর লিজের কারেন্ট পোরশন দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার টাকা, যা গত বছরের জুনে ছিল ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের শেষ তিন মাসে বা চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে কোম্পানিটির ঋণের কিস্তি বাবদ ২১ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং লিজের কিস্তি বাবদ ৮ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে।

এভাবে ঋণে আটকে থাকা কোম্পানিটি ২০২১ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ২০২১ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তারপর ২০২২ সালে ১২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

ঋণে আটকা লাভেলো যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’

কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়তে থাকলে গত ১৩ মে ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে বার্তা প্রকাশ করা হয়। কোম্পানিটির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিএসই জানায়, সম্প্রতি লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ারের যে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে, তার পিছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

ডিএসই এ তথ্য প্রকাশের পর আরও দুই মাস চলে গেলেও ডিএসই থেকে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অবশ্য ডিএসই সতর্কবার্তা প্রকাশ করার পর কোম্পানিটির শেয়ার দাম ১০০ টাকা থেকে কমে ৮৩ টাকায় নেমে আসে। তবে এখন আবার দাম বাড়ছে।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কারসাজির সন্দেহ করা স্বাভাবিক। কোনো বিশেষ গ্রুপ না থাকলে এভাবে শেয়ার দাম বাড়তে পারে না। এর আগেও কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর মাধ্যমে একটি বিশেষ চক্র সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে, বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শেয়ারবাজার।

তিনি বলেন, লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম বাড়ার পিছনে প্রকৃত ঘটনা কী, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তদন্ত করে বের করা। যদি কোনো কারসাজির ঘটনা ঘটে তবে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বারবার বাজারে কারসাজির ঘটনা ঘটবে।

ডিএসইর আরেক সদস্য বলেন, লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম বাড়ার পিছনে কোম্পানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইন্ধন থাকতে পারে। হঠাৎ করে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ার পিছনে ভূমিকা রেখেছে। এই বিক্রি বাড়ার বিষয়টি সঠিক কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।

যোগাযোগ করা হলে লাভেলো আইসক্রিমের কোম্পানি সচিব মোহিউদ্দিন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শেয়ার দাম বাড়ার পিছনে কোম্পানির কোনো হাত নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে আমাদের নোটিশ করা হয়েছিল, আমরা জানিয়েছি অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই।’

হঠাৎ বিক্রি বাড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ বিশেষ করে মার্চ মাসে খুব গরম ছিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ছিল ঈদ। ওই সময় পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল।’

তিনি বলেন, ‘গরম থাকলে স্বাভাবিকভাবেই আইসক্রিমের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। আমরা অ্যাবনরমাল কিছু করছি, বিষয়টি তেমন না। গত বছরের সঙ্গে আমাদের নয় মাসের আর্থিক প্রতিবেদন তুলনা করলে দেখবেন বিক্রি প্রায় কাছাকাছি। আমাদের প্রকৃত চিত্র যা, তাই আমরা দেখিয়েছি।’

ঋণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘একশ কোটি টাকা ঋণ এটার জন্য তেমন কিছু না। আমাদের টার্নওভার প্রায় একশ কোটি টাকা। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের ঋণ বাড়েনি বললেই চলে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।’

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদি কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম হঠাৎ বড় আকারে বেড়ে যায়, তাহলে সার্ভিলেন্স থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হয়। যদি লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দাম বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো ম্যানুপুলেশন বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এমএএস/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।