লাকসাম-চিনকী আস্তানা ডাবল লাইন

ব্যয়-মেয়াদ বাড়িয়েও নির্মাণে ‘ফাঁকি’, ঝুঁকিতে রেলপথ

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৭ এএম, ১৩ জুলাই ২০২৪
নির্মাণে সামগ্রী কম দেওয়ায় ঝুঁকিতে লাকসাম-চিনকী আস্তানা রেলপথ

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলযোগাযোগ গতিশীল করতে কুমিল্লার লাকসাম ও চিনকী আস্তানার মধ্যে বিদ্যমান সিঙ্গেল লাইন সেকশনকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। তবে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ করা হলেও নির্মাণে ‘ফাঁকি’ দেওয়ার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে রেলপথটি। এ অবস্থায় বিষয়টি তদন্ত করার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

আইএমইডি’র কুমিল্লার লাকসাম-চিনকী আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ (তৃতীয় সংশোধিত) শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি নতুন রেলপথ নির্মাণেও নির্মাণসামগ্রী কম দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সদ্যনির্মিত রেলপথে ব্যালাস্ট (ট্র্যাক বেড যার ওপর স্লিপার বসনো হয়) পরিমাপে ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মেইন রেললাইনে গড়ে ৬৯ দশমিক ২০ মিলিমিটার আব ২৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। নির্মাণসামগ্রী কম দেওয়ার ফলে রেলপথের ব্যালাস্টের কিছু অংশ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয় হয়েছে। ফলে রেলপথটি ঝুঁকিতে রয়েছে। কম ব্যালাস্টের বিষয়টি তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নের জন্য প্রকল্প স্থানের রেলপথ, ট্রেন চলাচল, ভৌত অবকাঠামো, যাত্রী ও পণ্যসেবাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট দলিলাদি-কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে যাত্রী তথা প্রকল্পের সুবিধাভোগী ও কন্ট্রোল গ্রুপের মতামত গ্রহণের জন্য কাঠামোগত প্রশ্নপত্রসহ পরিসংখ্যানভিত্তিক সংখ্যাগত জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। সমীক্ষার কি-ইনফরমেশন ইন্টারভিউ থেকে নিবিড় আলোচনা, ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পের অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব দেখা গেছে। রেলপথ নির্মাণে ব্যালাস্টের পরিমাণ কম দেওয়া হলো কেন- এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে জানতে চাইবে আইএমইডি।

আরও পড়ুন

আইএমইডি জানায়, বিদ্যমান প্রকল্পের নির্মিত লাইনের ৫টি স্থানে ব্যালাস্ট কুশনের পুরুত্ব মেইন লাইনের স্লিপারের নিচে ১৫০ মিলিমিটার থেকে ২৪৯ মিলিমিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। দরপত্রের স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে পুরুত্ব ২৫০ মিলিমিটার হওয়ার কথা। প্রকল্পের লোকেশন ১২১/৩ কিলোমিটার মেইন লাইনের স্থানে ২৫০ মিলিমিটার ব্যালাস্টের পুরুত্ব থাকার কথা, অথচ পাওয়া গেছে ২৪৯ মিলিমিটার। লোকেশন ১১৬/৭ কিলোমিটার মেইন লাইনের স্থানে ২৫০ মিলিমিটার ব্যালাস্টের পুরুত্ব থাকার কথা, অথচ পাওয়া গেছে মাত্র ১৬০ মিলিমিটার। ১০৫/৮ কিলোমিটার মেইন লাইনের স্থানে ২৫০ মিলিমিটার ব্যালাস্টের পুরুত্ব থাকার কথা, কিন্তু পাওয়া গেছে ১৫০ মিলিমিটার। লোকেশন ৯৭/৮ কিলোমিটার মেইন লাইনের স্থানে ২৫০ মিলিমিটার ব্যালাস্টের পরিবর্তে পাওয়া গেছে ১২৫ মিলিমিটার। এছাড়া লোকেশন ৮৮/৮ কিলোমিটার মেইন লাইনের স্থানে ব্যালাস্টের পুরুত্ব পাওয়া গেছে মাত্র ২২০ মিলিমিটার। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে রেলপথটি।

আইএমইডি জানায়, কম পাওয়া ব্যালাস্টের কিছু অংশ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয় হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা দরকার। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চারটি স্টেশন লোকবলের অভাবে বন্ধ। ফলে এ এলাকায় যাত্রীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। বন্ধ স্টেশন চারটি চালুর ব্যবস্থা যেন নিতে পারে। প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত পিসি স্লিপার দুর্ঘটনাজনিত কারণে চেইনেজ কিলোমিটার ১২১/৪ ও ১২১/২ কিলোমিটারের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। ভাঙা স্লিপারগুলো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রকল্প এলাকায় রেলের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, ফলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা অপসারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ফেন্সিং (বেড়া) করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে কমিশন।

লাকসাম-চিনকী আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রকল্পের কাজে যেখানে যেখানে ব্যত্যয় ঘটেছে আমরা চিঠি দিয়ে জানতে চাইবো। প্রতিবেদনের আলোকে চিঠি দিয়ে অগ্রগতি জানবো। রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে ত্রুটি পেয়েছি সেটা সংশোধন করতে বলবো। আমরা রিপোর্টে যতগুলো বিষয় পেয়েছি সবগুলো সমাধানের জন্য চিঠি দেবো।’

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য লাকসাম থেকে চিনকী আস্তানা পর্যন্ত ৮০ দশমিক ৪৭৫ কিলোমিটার নতুন ডাবল ট্র্যাক রেলপথ নির্মাণ। এর মধ্যে ৬১ কিলোমিটার মেইন লাইন এবং ১৯ দশমিক ৪৭৫ কিলোমিটার লুপ লাইন। এই পথে কম্পিউটার বেজড সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে লাইনের উন্নয়ন এবং সেকশনাল ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা যেন স্থানীয় জনসাধারণকে নিরাপদ, আরামদায়ক, স্বল্পব্যয়ে পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ সুবিধা দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলপথে বৃষ্টির পানি জমে। বর্ষার পানি নিষ্কাশনের জন্য স্টেশন এলাকায় ড্রেনেজগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা যেতে পারে। ব্যালাস্টের অপচয় রোধ করার জন্য অগ্রাধিকার এলাকা চিহ্নিত করে ক্রমান্বয়ে ব্যালাস্ট ওয়ালের দৈর্ঘ্য বাড়ানো যেতে পারে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদ্যমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।

রেলপথ নির্মাণে নির্মাণসামগ্রী কম দেওয়া প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শেখ সাকিল উদ্দিন আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কুমিল্লার লাকসাম-চিনকী আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ (তৃতীয় সংশোধিত) শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন আমাদের হাতে এখনো আসেনি। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ রেলওয়ে বাস্তবায়ন করে। আইএমইডি যদি প্রকল্পের কোনো গ্যাপ পায় তবে আমরা সবার মতামত নিয়ে এটা ঠিক করে দেবো।’

চারবার সংশোধন, ব্যয় বৃদ্ধি

রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন বাংলাদেশ রেলওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেশন। এই স্টেশনে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে মালবাহী ফ্রেইট ট্রেন এবং যাত্রীবাহী ট্রেনের বর্ধিত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জাইকার অর্থায়নে লাকসাম এবং চিনকি আস্তানার মধ্যে বিদ্যমান সিঙ্গেল লাইন সেকশনকে ডাবল লাইনে উন্নীত করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির জন্য আলোচ্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৮১৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ ৫২৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হয়।

প্রকল্পটির মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ২০০৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ৩০ জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ডিপিপি একবার বিশেষ সংশোধনসহ চারবার সংশোধিত হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন আইটেম পরিবর্তন ও ব্যয় বৃদ্ধি, অন্য নির্মাণকাজের পরিধি মূল অনুমোদিত ডিপিপির তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পটি তৃতীয়বার সংশোধন করা হয়। অর্থাৎ মূল ডিপিপির তুলনায় তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে ২৬২ দশমিক ৮২ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন

জলাবদ্ধতার ঝুঁকি নিরসন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ
প্রকল্পের আওতায় রেলসেতু ও কালভার্ট নির্মাণের ব্যবস্থা করায় জলাবদ্ধতার ঝুঁকি নিরসন হয়েছে। প্রকল্পের হিসাব নিরীক্ষা রেলওয়ে বিভাগের অভ্যন্তরীণ হিসাব দপ্তর এবং সরকারের নিরীক্ষা পরিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়েছে। প্রকল্পের পূর্তকাজের জন্য অনুমোদিত ডিজাইন অনুসরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করে মূল ডিপিপি অনুমোদন করা হয়েছে, ফলে ডিপিপির সংশোধন প্রয়োজন হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ মূল ডিপিপিতে বাস্তবসম্মতভাবে নিরূপণ করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন মেয়াদ মূল ডিপিপিতে পাঁচ বছর এবং তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে ১১ বছর বা ২২০ শতাংশ বেড়েছে। ব্যালাস্ট ওয়াল না থাকায় বিভিন্ন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যালাস্ট অপচয় হচ্ছে এবং মেইন রেললাইন, লুপলাইন ও সোল্ডারে ব্যালাস্ট কম দেখা যাচ্ছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্টেশন সংলগ্ন হাটবাজার/শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, ফলে এলাকার জনগণের প্রকল্পের কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে। দুস্থ নারীসহ নিম্নবৃত্ত জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চুক্তি মোতাবেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক বছর রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল। পরে তারা প্রকল্পের আওতায় নির্মিত রেললাইন, ব্রিজ ও যাবতীয় ভৌত অবকাঠামো বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে। নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে এই রেলপথের ভৌত অবকাঠামো সচল রাখার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

এমওএস/ইএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।