বাংলাদেশ-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে তুরুপের তাস ‘বিনিয়োগ আকর্ষণ’

ইব্রাহীম হুসাইন অভি
ইব্রাহীম হুসাইন অভি ইব্রাহীম হুসাইন অভি
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২৪
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

গত দেড় দশকে বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বেড়েছে ৪২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ছিল মাত্র ৩৫১ দশমিক ৪৫ কোটি ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারে। তবে আমদানির তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক কম।

চীন শুধু বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, তারা দেশের বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে এ সম্পর্কে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। দুই দেশের সরকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিতে আগ্রহী। উন্নয়ন সহযোগী এ দেশটির কাছ থেকে আরও ঋণ প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে চীনকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা ঋণের পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করেন।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১ হাজার ৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারের। চীন থেকে ১ হাজার ৭৮২ দশমিক ৬৬ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে, দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬৭ দশমিক ৭৩ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭১৫ কোটি ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ৩৪১ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আর বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি ছিল প্রায় ১০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য

২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (মে ২০২৪ পর্যন্ত) চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বেশি। এই সময়ে একক পণ্য হিসেবে চীনে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যার পরিমাণ ২৯ কোটি ডলার।

আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে চায়নিজ ব্যবসায়ীদের এখানে নিয়ে আসা যায়, বিশেষ করে আমরা যে ধরনের পণ্য আমদানি করি সেই খাতের ব্যবসায়ীদের। আমরা যদি চাহিদার ৫ শতাংশ কাঁচামাল নিজস্বভাবে উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের জন্য বড় অর্জন।- ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান

চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২৫ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে নিউক্লিয়ার রেক্টর ও বয়লার- যার মূল্য ছিল ২১৫ কোটি ডলার। ইলেক্ট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র আমদানি হয়েছে ১৭২ কোটি ডলারের।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চীনের পক্ষে। বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে, চীন বাংলাদেশকে তার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশ বাণিজ্য সুবিধা থেকে খুব বেশি  অর্জন করতে পারেনি।

কাজে লাগাতে পারছে না শুল্কমুক্ত সুবিধা

২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও চীনে রপ্তানি তেমন বাড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশের আমদানিতে চীনের অংশ বেড়েছে অনেক।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের আমদানিতে চীনের অংশ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

চীনের বাজারে বাংলাদেশ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পেলেও সম্ভাবনাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে পারেনি। চীনে রপ্তানি না বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ পণ্য বহুমুখীকরণের অভাব ও চীনের বাজার সম্পর্কে তথ্যের অভাব।

‘চীনের ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে যে ধরনের বৈচিত্র্যময় পণ্যে পূর্ণ ঝুড়ি দরকার তা বাংলাদেশের নেই। ফলে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি। বাজারের চাহিদা নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই।’ বলছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

চীন বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক হওয়া সত্ত্বেও সুবিধা করতে পারছে না।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা সত্য যে আমরা চীনে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশের সুবিধা নিতে পারিনি। যদিও তারা আমাদের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দেয়। তবে এখানে তৈরি পোশাক পণ্য সীমিত। আমাদের নতুন পণ্য তৈরি করতে হবে এবং আলোচনার মাধ্যমে তালিকায় আরও নতুন ধরনের পোশাক পণ্য যুক্ত করতে হবে।’

শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থেকে লাভ করতে বাংলাদেশ কি শুধু ঋণের প্রতি নজর দেবে নাকি বিনিয়োগেও নজর থাকবে সেটি এখন প্রশ্ন। আবার যদি বিনিয়োগ হয় তাহলে কোন ধরনের শিল্পে? অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, উৎপাদন ও পশ্চাদমুখী শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর এবং বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার ও পরিশোধের শর্ত এবং মেয়াদ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, যাতে ঋণের ফাঁদে আটকা না পড়ি।

বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্র

শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগাতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর চীন থেকে বাংলাদেশ ২৬ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মধ্যে থেকে প্রায় ১৩ কোটি ডলার এসেছে জ্বালানি খাতে এবং ৩ দশমিক ৩২ কোটি টেক্সটাইলে। এসময় বাংলাদেশ মোট ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। চীনের অবস্থান ছিল তৃতীয়।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় চীনের ভূমিকা অনেক। চীন বৈশ্বিক কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রপ্তানি ও দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি করি। সুতরাং আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না বরং বাড়বে। কারণ আমাদের ব্যবসার ধরন ও আকার দিন দিন বড় হচ্ছে।’

‘আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে চীনা ব্যবসায়ীদের এখানে নিয়ে আসা যায়, বিশেষ করে আমরা যে ধরনের পণ্য আমদানি করি সেই খাতের ব্যবসায়ীদের। আমরা যদি চাহিদার ৫ শতাংশ কাঁচামাল নিজস্বভাবে উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। এতে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে, আমদানিনির্ভরতা কমবে।’ মন্তব্য করেন কাসেম।

‘এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বাংলাদেশে ভূমিকা রাখতে পারে চীনা বিনিয়োগ। কারণ আমাদের অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেখানে চীনের বিনিয়োগ ও কৌশলগত সহায়তা প্রয়োজন। আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীন এখানে শীর্ষে।’

এ ব্যবসায়ী নেতা দাবি করেন, আমাদের রপ্তানি তৈরি পোশাকখাতনির্ভর। সুতরাং এখানে ভালো করেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। চীনের বিনিয়োগ পণ্য বহুমুখীকরণ ও উচ্চমূল্যের পোশাক পণ্য তৈরিতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ম্যানমেড ফাইবারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। চীন বৈশ্বিক বাজারে এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তাদের সামর্থ্য, সক্ষমতা ও প্রযুক্তি আছে।’

রাকিব বলেন, ‘আমরা যদি চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে পারি যে তারা এখানে এ শিল্পে বিনিয়োগ করবে এবং আমাদের প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করবে, তাহলে বাংলাদেশ এ খাতে অনেক ভালো করতে সক্ষম হবে।’

‘বাংলাদেশ যদি ম্যানমেড ফাইবারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানিতে চায়না প্লাস হতে চায়, তাহলে আমাদের তাদের কৌশলগত অংশীদার হতে হবে। যে সব দেশ ভালো করেছে তারা এ পদ্ধতির মাধ্যমে করেছে’ বলেন রাকিব।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও ওয়াজির অ্যাডভাইজরের গবেষণা অনুযায়ী, কৃত্রিম সুতা থেকে কাপড় তৈরিতে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে নন-কটন আরএমজি রপ্তানি থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী পোশাক উৎপাদনের ৭৫ শতাংশই নন-কটন ফাইবার। কিন্তু আমাদের রপ্তানিমুখী পণ্যের ৭১ শতাংশই সুতির তন্তুর ওপর নির্ভরশীল।’

‘আমরা যদি নন-কটন পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চাই তবে আমাদের কৃত্রিম কাপড় তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে। চীন বিদেশি বিনিয়োগের একটি বড় উৎস হতে পারে এবং তাদের এ খাতে উচ্চদক্ষতা ও জ্ঞান রয়েছে।’ জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি আরও বলেন, ‘চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য দুইভাবে লাভজনক হবে। কারণ এটি প্রযুক্তিগত জ্ঞান স্থানান্তর করবে এবং রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করবে।’

প্রযুক্তির প্রভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের কাজের ধরন। নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থায়। তাই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এখানে চীনের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে আমাদের এ নতুন প্রযুক্তি উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে পারমাণবিক, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং এখানে ব্যবসা প্রসারিত করতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। জলবায়ু-সহনশীল স্মার্ট ফার্মিং, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, বলে জানান বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘চীন নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে তাদের বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে হবে। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়ার সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের অভাবে আমরা এর সুফল পাচ্ছি না। এখানে চীনা যৌথ বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য উপকারী হতে পারে।’

বিনিয়োগ আকর্ষণে করণীয়

টেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, ‘চীন আমদানি-রপ্তানির দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করি তার তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। তৈরি পোশাকসহ অন্য শিল্পের পশ্চাদমুখী খাতে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। বিনিয়োগ এলে আমরা সহজে কাঁচামাল পাবো এবং স্বল্প সময়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারবো।’

চীন থেকে যে সব বিনিয়োগ ও ব্যবসা সরে আসছে সেগুলো আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাদের বিশেষ অঞ্চলে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তুহিন।

চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে উৎপাদনমুখী শিল্পে তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। জোর দিতে হবে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর। চীনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে পশ্চাদমুখী শিল্প গড়ে তুলতে হবে।- ড. এম এ রাজ্জাক

তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আমাদের নীতি ও আইনকে ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। কোথাও কোথাও আইনের সংস্কার প্রয়োজন। শুধু খাতা-কলমে নয়, বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ থাকতে হবে।’

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) জোরদার করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি

নতুন সুযোগ সৃষ্টি ও শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার কাজে লাগাতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আরেকটি হাতিয়ার। বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়াতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করতে দুই দেশ কাজ করছে। ২০২৬ সালের মধ্যে এ চুক্তি করার বিষয়ে আশাবাদী উভয় দেশ।

চীন বাংলাদেশের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী এবং বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের উন্নয়নে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিদ্যমান কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। অন্যদিকে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ও বাণিজ্য সুরক্ষা দিতে চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’

‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ার পর এ চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে। দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে শুল্কমুক্ত সুবিধা পূর্ণাঙ্গ রূপে কাজে লাগাতে পারবো।’ দাবি করেন বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা।

পাশাপাশি বাংলাদেশকে চীন থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত ব্যবসাকে আকৃষ্ট করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশ একটি একক দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং এশিয়ায় নমনীয় হওয়ার জন্য তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তর করছে। সুতরাং, এটি আমাদের জন্য একটি দুর্দান্ত বিকল্প হবে।

ঋণ না বিনিয়োগ?

‘আমরা চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের জন্য তহবিল পাচ্ছি। এগুলো আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক সহায়তা করেছে। কিন্তু উন্নত অবকাঠামোর সুবিধা কাজে লাগাতে শুধু ঋণ নয়, আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে এবং যেখানে বিনিয়োগ বাড়ালে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে সেটার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।’ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক জাগো নিউজকে একথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে উৎপাদনমুখী শিল্পে তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। জোর দিতে হবে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর। চীনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে পশ্চাদমুখী শিল্প গড়ে তুলতে হবে।’

অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারাও ঋণের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন।

আবুল কাসেম খান বলেন, ‘চলমান ও নতুন বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের তহবিল প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যাতে চায়নার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি এবং ঋণের ফাঁদে না পড়ি। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার, পরিশোধের সময় এবং সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। সুদ যাতে কম হয় সেজন্য জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর চীন থেকে বাংলাদেশ ২৬ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। 

২০২১ সালে কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও ৮৮ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করে চীন। ২০২২ সালে প্রতিশ্রুত ঋণ ১১২ দশমিক ৬৯ কোটি ডলার, ছাড় ৯৮ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে ২৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের বিপরীতে ১১৩ দশমিক ২৭ কোটি ডলার ছাড় করে চীন।

বাংলাদেশকে এ যাবত মোট ১০ দশমিক ২৯ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। ছাড় হয়েছে ৬ দশমিক ৫৪ কোটি মার্কিন ডলার।

আইএইচও/এএসএ/জিকেএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।