করজালে আটকিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ০৬ জুন ২০২৪

বাংলাদেশকে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। সেই বাংলাদেশ এখন বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। সমৃদ্ধির পথ ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে এখন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পূর্বসূরীর পথ ধরে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার প্রথম বাজেটে ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’র কথা বলেছেন। অঙ্গীকার করেছেন সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বালাদেশ বিনির্মাণের। তবে তেমন চমক না দেখিয়ে অনেকটাই সাদামাটা বাজেট দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে চেষ্টা করেছেন অধিক সংখ্যক মানুষকে করজালে আটকানোর।

স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায় জাতীর সামনে বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন, অন্যদিকে বিনাপ্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর দিয়ে তার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে পারবেন। এছাড়া নগদ অর্থসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা যাবে। এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট দেশ গড়তে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য সেবা, তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখাসহ ১৪ কার্যক্রমকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবন সহায়ক শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন তিনি। পাশাপাশি কৃষিখাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নত ও সম্প্রসারিত করা, তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

এছাড়া সম্ভাব্য সব সেবা ডিজিটাইলাইজড করাসহ সর্বস্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার বিষয়ে বলেছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০৩১ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্য নির্মূল করা ও ২০৪১ সালে নাগাদ সাধারণ দারিদ্র্যের হার তিন শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রী। একই সঙ্গে শিল্প স্থাপন ও বিনিয়োগে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ, জনকল্যাণমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তোলা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।

স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়েছেন, সেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন। ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে বলে আশা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ফলে দেখা যাচ্ছে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। সেখানে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে বেঁধে রাখার প্রত্যাশা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে একেবারে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন হলেও কিছু পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব বলে দাবি তাদের। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন। সরকার যদি পলিসিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে তবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি যেতে পারে।’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬০ শতাংশের সমান। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪১৮ টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।

এবার ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এছাড়া ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।

আসন্ন অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক কর অথবা ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এ তালিকায় রয়েছে- পানির ফিল্টার, এসি, ফ্রিজ, সিগারেট, জর্দা, গুল, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি বাল্ব, কাজুবাদাম, এলআরপিসি তার, জেনারেটর প্রভৃতি।

শিল্পে ব্যবহৃত ৩৩ আইটেমের কাঁচামাল আমদানিতে এক শতাংশ শুল্ক বসানো হচ্ছে। এ তালিকায় আছে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল, সিরিশ কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত টিউব লিসেনিং জেল, কৃত্রিম কোরান্ডাম, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, প্যাট চিপস উৎপাদনে ব্যবহৃত ইথিলিন গ্লাইকল, পানির মোটর উৎপাদনকারী অ্যালুমিনিয়াম ইনগট, ফ্লোরোসেন্ট বাতির যন্ত্রাংশ, কাচ, প্লাস্টিক, এলইডি টেলিভিশন উৎপাদনে ব্যবহৃত এলইডি বাল্ব, বাতি উৎপাদনে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয়, ওপেন সেল, ফাইবার ইত্যাদি। এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) বাড়াতে আগামী বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারামূল্য কিছুটা বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)। ট্যুর অপারেটর সেবায় মূসক অব্যাহতি প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, থিম পার্কে মূসক সাড়ে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নিলামকারী সংস্থা, সিকিউরিটি সার্ভিস ও লটারির টিকিটে মূসক ১০ শতাংশে পরিবর্তে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এসবে খরচ বাড়বে।

রাজস্ব বাড়াতে অর্থমন্ত্রী নির্মাণ উপকরণ ইটেও নজর দিয়েছেন। ইটের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুনির্দিষ্ট করের হার ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইসক্রিম ও কার্বনেটেড বেভারেজের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর ফলে দাম বাড়তে পারে আইসক্রিম ও কোমল পানীয়র। মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ই-সিম সরবরাহের ক্ষেত্রে মূসক ২০০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

গাড়ি আমদানিতে শুল্ক দিতে হবে সংসদ সদস্যদের। বর্তমানে সংসদ সদস্যরা বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি করতে পারেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি হাইটেক পার্কের জন্য আমদানি করা যেসব গাড়ি আগে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত, সেসব গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সমবায় সমিতির করহার বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সমবায় সমিতির করহার ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ধনীদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায় করতে আয়কর হারের একটি ধাপ বাড়ানো হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ করহার ৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ শতাংশ।

শুল্কফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে সোনা আনা ঠেকাতে অর্থমন্ত্রী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাগেজ বিধিমালা ২০২৩-এর ২ ধারায় সোনার অলংকার ও গয়নার উপযুক্ত সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে যাত্রীরা অল্প ডিজাইন করে ২৪ ক্যারেটের কাঁচা সোনাকে সোনার গয়না হিসেবে লুকিয়ে আনার মাধ্যমে শুল্ক এড়ানোর চেষ্টা করেন বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।

ব্যাগেজ বিধিমালার নতুন নিয়ম অনুসারে এখন থেকে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা ব্যাগেজ সংগ্রহে শুল্ককর দিতে হবে। বর্তমানে বিদেশ থেকে যাত্রীরা শুল্কছাড়া দুটি নতুন মোবাইল ফোন আনতে পারলেও নতুন নিয়মে কেবল একটি আনার সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ব্যাংকে বেশি টাকা জমাকারীদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরে ব্যাংকে জমা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এতে বড় আমানতকারীদের খরচ বাড়বে। বর্তমানে শুল্কের স্তর ছয়টি থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা বাড়ানো হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্কের যে স্তর রয়েছে, সেটি ভেঙে দুটি স্তর করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্ছিত টাকায় আগের মতোই তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক থাকবে। তবে ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি পর্যন্ত ৩ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫ হাজার টাকা শুল্ক বসবে।

একইভাবে এক কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান স্তরও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরে এক কোটি থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতে ১০ হাজার টাকা, দুই কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। বর্তমানে এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা। ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে সেই আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ হবে ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে এই স্তরে ৪০ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়।

বিপরীতে অর্থমন্ত্রী ২৮২ পণ্যের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও সংরক্ষণমূলক শুল্ক (আরডি) কমানোর প্রস্তাব করেছেন। প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধ আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা, চকলেট আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রত্যাহার করা হয়েছে ল্যাপটপের ভ্যাট। এতে সবমিলিয়ে পণ্যটিতে ৩১ শতাংশের পরিবর্তে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হবে।

কার্পেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল পলিপ্রেপাইলিন ইয়ার্ন আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এভিয়েশন খাতের উত্তরণকল্পে ইঞ্জিন-প্রপেলর আমদানি পর্যায়ে মূসক কমানো হয়েছে। রড, বার ও অ্যাঙ্গেল তৈরির কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত সুইচ-সকেট, হোল্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।

কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসে ব্যবহৃত উপকরণ ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিটের ওপর আমদানি শুল্ক ৯ শতাংশ কমানো হয়েছে। ডেঙ্গু কিটে রেয়াতি সুবিধা বলবৎ রাখা হয়েছে। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা সুলভ করতে ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধার আওতায় নতুন কিছু কাঁচামাল যোগ হয়েছে। রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রিক মোটর উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে। দেশে তৈরি মোটরসাইকেলের সিকেডি ইঞ্জিনের পার্টস আমদানির শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় বাবদ ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে কখনো পরিচালন ব্যয়ে এত বেশি হারে বরাদ্দ রাখা হয়নি। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া মূলধন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।

অপরদিকে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হচ্ছে ৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এ খাতের জন্য। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি। এ খতের জন্য বরাদ্দ ১৪ শতাংশ। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাত। পরিবহন ও যোগাযোগে বাজেটের ১০ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।

এছাড়া জনপ্রশাসনে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যণে ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪ শতাংশ, গৃহায়ণে শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ, বিনোদন সংস্কৃতি ও ধর্মে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ, পেনশনে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, বিবিধ ব্যয় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে ৬ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ২০ শতাংশ, কৃষিতে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষয় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যৌক্তিকভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। এ লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আরও ৯ লাখ ৮১ হাজার ৬১ জনকে যুক্ত করার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তির হার ১০০ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৫০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

নতুন করে আরও ৫ লাখ প্রতিবন্ধী, এক লাখ ৫০ হাজার ৪৮০ জন মাতৃত্বকালীন, ২ লাখ বয়স্ক ব্যক্তি, ২ লাখ বিধবা, ৫ হাজার ৭৪৯ জন তৃতীয় লিঙ্গের এবং ৯০ হাজার ৮৩২ জন সমাজের অনগ্রসর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ ভাতার আওতায় আনা হবে।

সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৯ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।

এমএএস/কেএসআর/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।