এলাচ-হলুদের বাজার চড়া, জিরা-লবঙ্গে স্বস্তি

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১১:২২ এএম, ৩০ মে ২০২৪
বিভিন্ন ধরনের মসলা/সংগৃহীত

কোরবানির ঈদে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে সব ধরনের মসলার। বিশেষ করে গরম মসলার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। এবার ঈদের তিন সপ্তাহ আগে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেশকিছু মসলার দামে রয়েছে স্বস্তি। গত বছরের তুলনায় কমেছে জিরা, লবঙ্গের দাম। তবে এলাচ, দারুচিনির পাশাপাশি দেশি হলুদ, শুকনো মরিচ, ধনিয়ার দাম কিছুটা চড়া।

গরম মসলার প্রায় পুরো বাজারটাই বিদেশনির্ভর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ডলার সংকট, ব্যাংকগুলোতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে অনীহার পাশাপাশি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মজুতদারির কারণেও মসলা বাজারে প্রভাব পড়েছে। তবে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবার মিশ্র প্রভাব রয়েছে বাজারে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, বাজারে মসলা পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কোরবানি উপলক্ষ করে কৌশলে দাম বাড়াচ্ছেন। যারা দাম বাড়াচ্ছেন তাদের অনেকেই মসলা ব্যবসায়ী নন। অন্য ব্যবসা থেকে বিনিয়োগ তুলে বেশি লাভের আশায় মসলায় বিনিয়োগ করে বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, গরম মসলার ৯০ শতাংশই আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি এলাচ আমদানি হয় গুয়েতেমালা থেকে। ভারত থেকেও কিছু এলাচ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। গরম মসলার মধ্যে অন্যতম লবঙ্গ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। মাদাগাস্কার থেকে অল্প পরিমাণে লবঙ্গ আমদানি হয়। বাজারে দারুচিনি আমদানি হয় চায়না ও ভিয়েতনাম থেকে।

এলাচ-হলুদের বাজার চড়া, জিরা-লবঙ্গে স্বস্তি

বাংলাদেশে বেশি জিরা আমদানি হয় ভারত ও আফগানিস্তান থেকে। সিরিয়া, চায়না থেকেও জিরা আমদানি হয়। তবে ভালো মানের কারণে আফগানিস্তান ও ভারতীয় জিরার দাম বেশি থাকে। সরকারিভাবে ডিউটি বাড়ানোর কারণে কয়েকটি মসলার দাম বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ২০২৩ সালে দারুচিনি, লবঙ্গ ও জিরা বেশি আমদানি হয়েছে। শুধু এলাচ আমদানি কমেছে। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের চেয়ে গত বছর (২০২৩ সালে) ৫৬৭ টন ৩৯৬ কেজি লবঙ্গ বেশি আমদানি হয়। গত বছর লবঙ্গ আমদানি হয় ১৫শ ৫ টন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ মে পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮০ টন ৫শ কেজি।

২০২২ সালে দারুচিনি আমদানি হয় ২৭৪ টন ৮৩৫ কেজি। পরের বছর ২০২৩ সালে আমদানি হয় ৩২৫ টন ২৫৫ কেজি। চলতি বছর ১৪ মে পর্যন্ত দারুচিনি আমদানি হয়েছে ১শ টন ৩১৭ কেজি। ২০২৩ সালে এলাচ আমদানি হয় ৪ হাজার ৬৭৭ টন ২৯০ কেজি। আগের বছর এর চেয়ে ১ হাজার ৩২৪ টন বেশি আমদানি হয়েছিল। চলতি বছরের ১৪ মে পর্যন্ত এলাচ আমদানি হয়েছে ৬৮৭ টন ৮৮০ কেজি। একই সময়ে জিরা আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৫১৬ টন ৮২৫ কেজি। ২০২৩ সালে আমদানি হয় ৮ হাজার ৪৭৭ টন জিরা।

আরও পড়ুন

মঙ্গলবার (২৮ মে) সরেজমিনে খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, আমদানি কম হলেও চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারের আড়তগুলোতে কোরবানির অত্যাবশ্যকীয় এ উপকরণগুলোর জোগান রয়েছে। গত বছরের তুলনায় জিরা ও লবঙ্গের দাম কম থাকলেও বেড়েছে এলাচ ও দারুচিনির দাম। দেশি মসলার মধ্যে মরিচ, ধনিয়া, হলুদের দাম আগের বছরের তুলনায় চড়া।

এলাচ-হলুদের বাজার চড়া, জিরা-লবঙ্গে স্বস্তি

বাজারে সবচেয়ে বেশি অস্থির এলাচের দাম। ডিও সিন্ডিকেটের কাছে ভালোমানের এলাচের চেয়ে মধ্যমমানের এলাচের দাম বেশি। তবে যারা বাজার থেকে এলাচ কিনছেন, একই এলাচ ট্রেডিংয়ের চেয়ে প্রতি কেজিতে ৮শ থেকে ৯শ টাকা কম। ভালোমানের এলাচের মধ্যে রয়েছে ‘আরএস’ ও ‘আরএস জাম্বো’। এসব এলাচের দাম বর্তমানে ৩৬শ থেকে ৩৭শ টাকা। একমাস আগেও এসব এলাচের দাম কেজিতে ৩শ টাকা কম ছিল। বাজারে মধ্যমমানের ‘ওয়াইএম-টু’ ‘ওয়াইএম’ ‘এলএমজি’ নামের এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ টাকা।

একমাস আগে একই এলাচের দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১শ টাকা। অপেক্ষাকৃত কমমানের ‘এসএমজি’ ‘এসএসবি’ নামের এলাচ বিক্রি হচ্ছে কেজি ২ হাজার ৮শ টাকা। গত বছর কোরবানির আগেও এসব এলাচের দাম মানভেদে এক হাজার থেকে ১ হাজার ৩শ টাকা দাম কম ছিল।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ১ হাজার ৩৫০ টাকা কেজিতে লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে। একমাস আগেও লবঙ্গের দাম কেজিতে একশ টাকা বেশি ছিল। গত বছর কোরবানির আগে এসব লবঙ্গের দাম কেজিতে বেশি ছিল ৩শ টাকা। বাজারে ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা কেজিতে দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে। একমাস আগে এসব দারুচিনির দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪শ টাকা। একবছর আগে তিনশ টাকার নিচে ছিল দারুচিনির দাম। বাজারে প্রতি কেজি গোলমরিচ বিক্রি হচ্ছে ৭শ টাকা ও সাদা গোলমরিচ এক হাজার টাকায়। খাতুনগঞ্জে জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭শ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও ৭৩০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। এক মাস আগে এসব জিরার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৬শ টাকা। খাতুনগঞ্জের বাজারে একই জিরা গত বছর ১ হাজার ১শ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

বাজারে ভারতীয় হলুদ ২৭৫ টাকা এবং দেশি হলুদ ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। একবছর আগেও এসব হলুদ ১১৫-১৩০ টাকা বিক্রি হতো। বাজারে এবার দেশি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজিতে। গত বছর একই ধনিয়া বিক্রি হয় ১২০ টাকায়। বাজারে ভারতীয় মরিচ ৩৪০-৩৫০ টাকা, কুমিল্লা জাতের মরিচ ২২০ থেকে ২৪০ টাকা ও হাটহাজারী জাতের মরিচ ২৮০ টাকা।

গরম মসলা ব্যবসায়ী মো. বাদশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এলাচ ও দারুচিনির দাম বেড়েছে। কমেছে জিরা ও লবঙ্গের দাম। গত বছর যে জিরা ১ হাজার ১শ টাকায় বিক্রি হতো এখন সে জিরা ৭শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝে ৬শ টাকায়ও নেমেছিল। গত বছর লবঙ্গ বিক্রি হয়েছিল কেজিপ্রতি তিনশ টাকার কমে। এবছর একই লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ৪৭০ টাকা। মূলত ডিউটি বাড়ানোর কারণে কয়েকটি মসলার দাম কিছুটা বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কোরবানির আগেভাগে বাজারে এমনিতেই গরম মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। যে কারণে বাজারে দাম চড়া হয়। চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মুদি দোকানিরা খাতুনগঞ্জ থেকে গরম মসলা সংগ্রহ করেন।’

এলাচ-হলুদের বাজার চড়া, জিরা-লবঙ্গে স্বস্তি

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে মসলার দাম। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম। এরপর ৫০ শতাংশ বেড়েছে হলুদের দাম। আবার ৪ শতাংশের কাছাকাছি কমেছে জিরার দাম। লবঙ্গে সাড়ে ৬, দারুচিনি সাড়ে ৯, ধনিয়ার দাম কমেছে ৫ শতাংশের মতো।

টিসিবির মতে, খুচরা বাজারে জিরা ৭৫০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৫শ টাকা, ছোট এলাচ ৩ হাজার ২শ টাকা, দারুচিনি ৫শ টাকা, দেশি শুকনা মরিচ ৩২০ টাকা, ভারতীয় মরিচ ৪২০ টাকা, দেশি হলুদ ৩৫০ টাকা, ভারতীয় হলুদ ২৮০ টাকা, দেশি নতুন হলুদ ৪শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মেসার্স তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান বাদশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে মসলা আমদানি কম হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি দিতে পারেনি। যারা এলসি করেছে তারা ব্যবসা করছে। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান মৌসুমের শুরুতে দেশি মসলা বিশেষ করে মরিচ, ধনিয়া, হলুদ মজুত করেছে। এতে পুরো বছর এসব মসলার দাম বেশি থাকছে।

বাংলাদেশ মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি এবং খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক মেসার্স এবি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী অমর কান্তি দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘পেঁয়াজ বাদেও এলাচ, জিরা, হলুদ, মরিচসহ বেশকিছু মসলাজাতীয় পণ্যের একটি অংশ ভারত থেকে আসে। ভারতে দাম বাড়লে আমাদের দেশে বাড়ে। পাশাপাশি ডলারের দামের কারণে এলসি খুলতে পারছেন না অনেক আমদানিকারক। যার প্রভাব পড়েছে খাতুনগঞ্জের মসলার বাজারে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।