‘কর অব্যাহতি তুলে নিলে টেক ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে’
বিগত ১৩ বছর ধরে ২৭টি ডিজিটাল সেবা খাতে কর অব্যাহতি দিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০১১ সাল থেকে দেওয়া এ সুবিধা শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির সুযোগ বাড়িয়ে ২০৩১ সাল পর্যন্ত বলবৎ করার দাবি জানিয়েছে প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনগুলো। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও এই কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়াতে আবেদন জানিয়েছেন এনবিআরে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কর অব্যাহতি তুলে দিলে পিছিয়ে পড়বে এ খাত। সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন হ্যালো টাস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ ইমপ্যাক্ট অফিসার মাহমুদুল হাসান লিখন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক সাইফুল হক মিঠু
জাগো নিউজ: নতুন বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি বাদ দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কর অব্যাহতি উঠলে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে?
মাহমুদুল হাসান লিখন: কর অব্যাহতি উঠলে ছোট-বড় সব স্টার্টআপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একে তো আমরা মুনাফা কম করি, যতটুকু করি তার ওপরে যদি করপোরেট কর দেওয়া লাগে তাহলে কেউই লাভ করতে পারবে না। তবে ক্ষতিটা কত বড় হবে এটা বলা কঠিন।
জাগো নিউজ: দীর্ঘসময় ধরে অব্যাহতির সুবিধা পাওয়ার পরও তথ্যপ্রযুক্তি খাত অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারছে না কেন?
মাহমুদুল হাসান লিখন: প্রায় এক যুগ ধরে কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত তো ২০১৭-১৮ সাল থেকে বিকাশ করছে। পোশাক খাত আমাদের অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি খাত সে পর্যায়ে যায়নি। পোশাক খাতকে এখনো বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রযুক্তি খাতে কতটুকু প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে? কোভিডকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা পাইনি। যতটুকু সুবিধা পাচ্ছিলাম সেটাও যদি তুলে নেওয়া হয় তাহলে টেক ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে।
আরও পড়ুন
- তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ না বাড়ানোর পরামর্শ আইএমএফের
- আইটি খাতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি চান পলক
- আইসিটি খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী সম্মত
জাগো নিউজ: নতুন বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
মাহমুদুল হাসান লিখন: প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের ইকো সিস্টেমের পরিবর্তন দরকার। এজন্য বাজেটে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে। আমরা এখনো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাই না। বিদেশি বিনিয়োগ যেটা আসছে সেটা আমাদের দুবাই বা সিঙ্গাপুর বেজড কোম্পানিতে আসছে। ধরুন, পাঠাও’র বিনিয়োগকারী সরাসরি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে না। বিদেশে নিজস্ব কোম্পানি থেকে বাংলাদেশের হোল্ডিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ হিসেবে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা খুবই কঠিন।
আমরা এখনো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাই না। বিদেশি বিনিয়োগ যেটা আসছে সেটা আমাদের দুবাই বা সিঙ্গাপুর বেজড কোম্পানিতে আসছে। ধরুন, পাঠাও’র বিনিয়োগকারী সরাসরি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে না। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা খুবই কঠিন।
জাগো নিউজ: সরাসরি বিনিয়োগ কেন আসছে না? এতে সমস্যা কী?
মাহমুদুল হাসান লিখন: আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতা আছে। অনেক জায়গায় নিবন্ধন করতে হয়। দেশে এখনো ই-সিগনেচারের প্রচলন নেই। বিদেশি বিনিয়োগকারীকে যদি ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই করতে বাংলাদেশে আসতে হয় তাহলে কেন আসবেন তিনি! বিদেশি বিনিয়োগ আনতে আমাদের অন্য দেশে কোম্পানি করা লাগছে। ওই কোম্পানি চালাতে আমাদের প্রতি মাসে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হচ্ছে, এই ব্যয় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। দেশে বিনিয়োগকারীর মুনাফা বণ্টন বা এক্সিট কীভাবে হবে এটা ঠিক নেই।
জাগো নিউজ: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনাদের কেমন ভ্যাট- ট্যাক্স দেওয়া লাগছে?
মাহমুদুল হাসান লিখন: আইটি এনাবেল সার্ভিস হিসেবে ৫ শতাংশ ভ্যাট দেই। তবে অন্যান্য বিষয়ে ১৫ শতাংশই ভ্যাট দিতে হয়। এছাড়া কর তো দিতে হয়। টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয় শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ফেসবুক, ইউটিউবে বিজ্ঞাপনে ভ্যাট দিতে হয়।
জাগো নিউজ: এখনো কেন আপনাদের অব্যাহতির সুবিধা প্রয়োজন?
মাহমুদুল হাসান লিখন: পোশাক খাতের বিকল্প হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া অন্য কোনো টেকসই শিল্প গড়ে তোলা অসম্ভব। প্রযুক্তি খুবই দ্রুত বর্ধনশীল, আমাদের কর্মক্ষম তারুণ্য আছে। সর্বস্তরে ইন্টারনেট সুবিধা আছে। ফ্রিল্যানসিংয়ে আমরা দ্বিতীয় ছিলাম। এখন ফ্রিল্যানসার হায়ারে ৩০ দেশের মধ্যে আমরা ২৯তম। এখাতে এগোতে হলে আরও কিছুদিন সহযোগিতা দরকার।
প্রযুক্তি খুবই দ্রুত বর্ধনশীল, আমাদের কর্মক্ষম তারুণ্য আছে। সর্বস্তরে ইন্টারনেট সুবিধা আছে। ফ্রিল্যানসিংয়ে আমরা দ্বিতীয় ছিলাম। এখন ফ্রিল্যানসার হায়ারে ৩০ দেশের মধ্যে আমরা ২৯তম। এখাতে এগোতে হলে আরও কিছুদিন সহযোগিতা দরকার।
জাগো নিউজ: ফ্রিল্যানসিংয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?
মাহমুদুল হাসান লিখন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বিগ ডেটায় আমরা অনেক পিছিয়ে। এখানের ছেলে-মেয়েরা খুব সাধারণ কাজ করে। ডেটা এন্ট্রি, ভিডিও এডিটিং এসব। অ্যানালাইটিক্যাল স্কিল আমাদের ছেলে-মেয়েদের নেই। আবার বিদেশ থেকে আয়ের টাকা আনাটাও সহজ নয়। বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল কোনো গেটওয়ে নেই। ফ্রিল্যানসারদের অর্থ লেনদেনে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন
শুধু কর ছাড় নয়, এ খাতে অবকাঠামো দরকার। বড় বিনিয়োগ দরকার। এ খাতে দরকার রেভ্যুলেশন। তা না হলে কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে, বলেন মাহমুদুল হাসান লিখন।
আরও পড়ুন
- তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি পুরোপুরি তুলে না দেওয়ার প্রস্তাব
- ৬ প্রকল্পে চীনের কাছে এক বিলিয়ন ডলার চায় বাংলাদেশ
- ভারতে আইটি সেক্টরে কোন নির্বাহী প্রধানের বেতন সবচেয়ে বেশি?
জাগো নিউজ: এখন দক্ষ কর্মী কেমন পাচ্ছেন?
মাহমুদুল হাসান লিখন: বড় পদ বাদ দিলাম, মধ্যম পর্যায়ের পদেও দক্ষ কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে চাকরিপ্রত্যাশীদের হাহাকার, চাকরি নেই। অন্যদিকে চাকরিদাতারা দক্ষ জনবল পাচ্ছে না।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে স্টার্টআপ ওয়েব কি দিক হারিয়েছে? পাঠাও, হ্যালো টাস্ক, ট্রাক লাগবের মতো নতুন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
মাহমুদুল হাসান লিখন: গ্লোবালি ফান্ডিং সুবিধা অনেক কমে গেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটা বাংলাদেশ। স্টার্টআপ অপারেশনাল মেথড হচ্ছে বিনিয়োগনির্ভর, মুনাফানির্ভর নয়। মার্কেট আমরা ধরতে চাই। তবে এজন্য মুনাফা আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি নয়।
‘গ্রোথ করতে গেলে বিনিয়োগ লাগবেই, ইনভেস্ট ইকোসিস্টেম লাগবে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ ফ্লো ছিল। তখন আমরা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছি। এরপর করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানান কারণে বিনিয়োগ কমেছে। ভারত ও পাকিস্তানে বড় স্টার্টআপ ফেইল করছে টাকার অভাবে। ২০২২ সাল থেকে বিনিয়োগ কমার প্রভাব আমরা দেখছি। বড় ভেঞ্চার বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে। আমরা ফান্ড রেইজ করতে পারছি না। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, দেশে ডলার সংকট- সবমিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এজন্য আমাদের লোকাল ইনভেস্টমেন্ট দরকার।’
ব্যাংকের মুনাফার এক শতাংশ স্টার্টআপে বিনিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা আছে। কিন্তু ব্যাংক কাউকে টাকা দেয় না। আমাদের মর্টগেজ দেওয়ার মতো কিছু নেই। তবে ইক্যুইটি এক ধরনের মর্টগেজ হতে পরে। অনেক দেশের উদ্যোক্তারা এভাবে ঋণ নিচ্ছেন।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশেও বড় প্রতিষ্ঠান আছে, তারা বিনিয়োগ করে না কেন?
মাহমুদুল হাসান লিখন: অন্য দেশে করপোরেট প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশে করে না। এখানে হাই রিস্ক, হাই রিটার্ন মডেল আছে। এটা তারা বোঝে না। করপোরেট স্টার্টআপ বোঝে না। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সুবিধা দিতে পারে সরকার। যেমন কেউ যদি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে তাহলে তাকে কর সুবিধা দেওয়া হবে। ব্যাংকও আমাদের টাকা দেয় না, বিদেশি বিনিয়োগের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগ কোনো কারণে বন্ধ হলে কোম্পানিগুলো ঝরে পড়বে।
ব্যাংকের মুনাফার এক শতাংশ স্টার্টআপে বিনিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা আছে। কিন্তু ব্যাংক কাউকে টাকা দেয় না। আমাদের মর্টগেজ দেওয়ার মতো কিছু নেই। তবে ইক্যুইটি এক ধরনের মর্টগেজ হতে পরে। অনেক দেশের উদ্যোক্তারা এভাবে ঋণ নিচ্ছেন।
জাগো নিউজ: তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আগামীতে সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
মাহমুদুল হাসান লিখন: আমাদের নতুন আইটি এনাবেল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মানুষ স্টার্টআপ, ফ্রিল্যানসিং শিখছে, জানছে। তারপরেও আমরা অনেক দূরে আছি। ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেস্ক, ওয়ানস্টপ সার্ভিসে আমরা পিছিয়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আসতে চান না। আমাদের জন্য প্রণোদনার কোনো প্যাকেজ নেই। বরং ফরেন ট্রানজেকশন ভ্যাট দেওয়া লাগে। ফলে কর অব্যাহতি তুলে নিলে আমরা এগোতে পারবো না। যদি এটা করপোরেট ট্যাক্সের মতো বা ২০-৩০ শতাংশ করা হয়, তাহলে আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।
এসএম/কেএসআর/এমএস