শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে শ্রম আইন আরও উন্নত করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে বাংলাদেশের শ্রম আইন আরও উন্নত করতে বলেছে দেশটি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল (ইউএসটিআর) এ পরামর্শ দিয়েছে।
রোববার (২১ এপ্রিল) সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয় সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমেরিকার বাজারে সবসময় ডিউটি ফ্রি, কোটা ফ্রি বাজারের দাবি করে আসছি। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা। এর মধ্যে গার্মেন্টস পণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্য যাতে রপ্তানি করতে পারি। রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়েও আলোচনা হয়ছে। যেমন- চামড়াজাত পণ্য, সিরাকিম, ওষুধ ইত্যাদি।’
‘আর একটি হলো আমেরিকার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) বলে একটি বড় ফান্ড আছে। সেখান থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যখন আমরা ডিউটি ফ্রি, কোটা ফ্রি সুবিধা চাই, ডিএফসি ফান্ডের অংশীদারত্ব চাই- তখন তাদের দিক থেকে বলা হয় আমাদের লেবার রাইটস আরও উন্নত করতে হবে। আমাদের কিছু আইনের উন্নয়ন হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন আরও ভালো করতে হবে’, বলেন তপন কান্তি ঘোষ।
জিএসপি সুবিধা পেতে শ্রম আইনের যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলোতো অনেক পূরণ হয়েছে, আর কোনো শর্ত দিয়ছে কি না বা শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে নতুন কিছু বলেছে কি না? সাংবাদিকদের পক্ষে থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের নেতা প্রথমেই বলেছেন আমরা যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বা ডিএফসি ফান্ডে অংশীদারত্ব চাচ্ছি এর জন্য আমাদের শ্রম আইন আরও উন্নত করতে হবে।’
‘আমরা যে আইনটা করতে যাচ্ছি সেখানে আরও কয়েকটি বিষয় পুনর্গঠন করতে চাচ্ছি। এর মধ্যে একটা হচ্ছে এখন আইনে আছে কমপক্ষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে একটি ট্রেড ইউনিয়ন হতে পারে। সেটাকে আরও কমাতে বলেছেন। শ্রম আইনে অপরাধ করলে মালিকদের বিরুদ্ধে যে শাস্তির বিধান বা জরিমানা আছে সেটাকে আরও বাড়াতে হবে। কোনো ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাওয়ার পর তাদের সদস্য সংখ্যা ২০ শতাংশের নিচে হলেও তা বাতিল করা যাবে না। এরকম ১১ দফার একটি দাবি তারা দিয়েছেন। এগুলো তারা নতুন আইনে দেখতে চান। এ বিষয়ে আমরা বলেছি শ্রম মন্ত্রণালয়ে এটা পাঠাবো। তারা বিচার বিবেচনা করে দেখবে।’
শ্রমনীতির বিষয়ে কোনো ধরনের কথা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘শ্রমনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আজ শুধু টিকফা প্লাফর্মের অধীনে যে এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয় সেগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের দিক থেকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া, পোশাকখাতের বাইরেও যাতে অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করতে পারি, আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে সহজে এফডিএর রেজিস্ট্রেশন পায় এসব বিষয় জোর দিয়ে আলোচনা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘তাদের দিক থেকে বলেছে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতি আরও উন্নত করতে হবে, শ্রম আইনে আরও সংস্কার আনতে হবে, কিছু অ্যান্টি ইউনিয়ন চিহ্নিত করার বিষয়ে বলেছে, যাতে দ্রুত শ্রম আদালতে মামলা হয় এবং নিষ্পত্তি করা হয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু শ্রমনীতির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে তাদের মুল বক্তব্য কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ, যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব দেশে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। ডব্লিউটিও’র আইন অনুযায়ী আমাদের সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। আরও বলেছি সব স্বল্পোন্নত দেশের যে জনসংখ্যা তার ১৮ শতাংশ বাংলাদেশে বাস করে। সে হিসেবেও সুবিধাটা আমেরিকার দেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তৈরি পোশাকখাত। এই খাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা বেশি কাজ করেন। তারা গরিব পরিবার থেকে এসে এখানে কাজ করেন। কাজেই দারিদ্র্য দূরীকরণের একটা বিষয় আছে। তাদের আয় বাড়বে। একটি আইনে আফ্রিকান দেশগুলোকে তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেন। আমরা বলেছি, আফ্রিকা গরিব আর এশীয় গরিবদের মধ্যে কেন বৈষম্য হবে। এটা যুক্তিযুক্ত না।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ‘এই তৈরি পোশাক খাতের একটা অংশ কটন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে থাকি। অন্তত শেষ পর্যন্ত আমরা দাবি করেছি, যুক্তরাষ্ট্রের কটন থেকে যেই পোশাক তৈরি হবে, সেই অংশের ওপর যেন শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশ হতে এখনো কয়েক বছর বাকি আছে আমাদের।’
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কেউ কাউকে দয়া করে না। আমাদের যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা কোনো অগ্রাধিকারমূলক সুবিধাও পাই না, যে বলা চলে আমরা কারও দয়ায় রপ্তানি করছি। কাজেই সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কঠোর পরিশ্রম করে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রপ্তানি করছি।’
তিনি বলেন, ‘টেকনোলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে ডব্লিউটিও’র আইন অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে। কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে তারা সহায়তা করবে সে বিষয়টি আমরা মনে করে দিয়েছি।’
‘এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ আইনের একটা খসড়া করা হয়েছে। সেখানে তারা বিভিন্ন সময়ে মতামত দিয়েছেন। সে বিষয়ে তারা সন্তুষ্ট। তবে এই আইনসহ অন্য যেসব আইন যেমন কপিরাইট আইন, প্যাটেন্ট আইন এসব আইনের বাংলা তারা পায়। সে জন্য তারা আইন প্রণয়নের সময় ইংরেজি ভার্সন করতে বলেছেন।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ‘কৃষিখাত নিয়ে একটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা হলো আমাদের পণ্য রপ্তানি করতে গেলে যে সার্টিফিকেশন লাগে সে বিষয়ে আরও সহযোগিতা করতে চায়। এগুলোই মোটামুটি আমাদের আলোচনার এজেন্ডা ছিল। দুই পক্ষই জোরালোভাবে দাবিগুলো তুলে ধরেছে।’
এমএএস/কেএসআর/জিকেএস