কমলো উৎসে কর
চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে বড় বাধা পরিবেশ দূষণ
• চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর কমালো এনবিআর
• চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে বড় বাধা পরিবেশ দূষণ
• ট্যানারিগুলোর আন্তর্জাতিক মান সনদ পেতে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা
• এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বছরে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা
কম দাম ও ভালো মানের কারণে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে দেশের চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য। তবে আন্তর্জাতিক মান সনদ না থাকায় রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না শিল্পটি। এমন বাস্তবতায় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চামড়া বা চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর কমিয়ে ১ শতাংশ থেকে দশমিক ৫ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফলে কিছুটা স্বস্তি পাবেন উদ্যোক্তারা। এতে বাড়বে কর্মসংস্থান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানি বাড়াতে উৎসে কর কমিয়ে খুব একটা সুফল হবে না। রপ্তানি বাড়াতে এ খাতে কমপ্লায়েন্স বাড়াতে হবে।
কোনো কারখানার কাজের পরিবেশ, শ্রমিক নিরাপত্তা ও অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা সন্তোষজনক হলে ওই কারখানার সঙ্গে লেনদেনে সম্মত হয় বিদেশি ক্রেতারা। এক্ষেত্রে ওই কারখানাকে সরকার আরোপিত এবং ক্রেতাদের নির্দেশিত কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও আইন মেনে চলতে হয়। ওই আইন ও নীতিমালার আলোকে কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীরা যেন সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করাই কমপ্লায়েন্স।
‘চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য খাতের মূল সমস্যা পরিবেশ দূষণ। এজন্য বিশ্বের বড় বাজার ধরতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। কমপ্লায়েন্সের উন্নতি হলে এ খাতে রপ্তানি বাড়বে।’ — এনবিআর চেয়ারম্যান
চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য। এ খাতের পণ্য থেকে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছর ১৩৩ কোটি বা ১৩ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ৭১ কোটি ডলারের চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় পৌনে ২ শতাংশ কম।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ খাতে নানা চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছিল লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)। এসময় চামড়াজাতপণ্য ও জুতা রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল এলএফএমইএবি।
আরও পড়ুন
- ট্যানারি ব্যবসায়ীদের স্বল্পকালীন পরিবেশ সনদ দেওয়া হবে
- কোরবানির পর অবৈধ চামড়া কারখানার ছাড়পত্র বাতিল শুরু
- নগদ সহায়তার ওপর ১০ শতাংশ কর প্রত্যাহার চায় এলএফএমইএবি
এ বিষয়ে এলএফএমইএবির সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের এ উদ্যোগে চামড়াজাতপণ্যের রপ্তানি বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
পশুর ফিনিশড চামড়া
চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যের রপ্তানি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজগুলোর জ্বালানি খরচ সাড়ে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জানুয়ারিতে রপ্তানি পণ্যের নগদ প্রণোদনা কমায় সরকার। ক্রাস্ট চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ফিনিশড চামড়ায় প্রণোদনা কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এ বাস্তবতায় উৎসে কর কমানোর সিদ্ধান্তে খুশি উদ্যোক্তারা।
‘এ খাতে প্রণোদনা কমিয়ে লাভ নেই। এটা কমিয়েও তো আমরা ইউরোপ বা অন্য দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারবো না। কমপ্লায়েন্স ইস্যুর কারণে আমরা বাজার ধরতে পারছি না।’ — বিআইআইএসএস সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর
তারা বলছেন, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে বড় বাধা পরিবেশ দূষণ। সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। দূষণের কারণে ট্যানারিগুলোর আন্তর্জাতিক মান সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। এতে রপ্তানির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য বিক্রি করতে হলে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়।
আর পড়ুন
- বছরের শুরুতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি
- বেনাপোলে আটকা আমদানির ৪২ হাজার কেজি মহিষের চামড়া
- ঈদের আগেই চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি নিশ্চিতকরণের নির্দেশ
জানা গেছে, বাংলাদেশে মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা এমন বাজারে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি করে যেখানে ব্র্যান্ড মূল্য নেই। দেশ থেকে এলডব্লিউজি সনদবিহীন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত প্রতিটি চামড়া ন্যূনতম ৪৫ সেন্ট থেকে শুরু করে ১ দশমিক ৬০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে। যদিও এলডব্লিউজি সনদধারী কারখানা আরও বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারছে। তাই চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে উদ্যোক্তারা।
কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার
প্রাক-বাজেট আলোচনায় চামড়াখাতে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, এ খাতের মূল সমস্যা পরিবেশ দূষণ। এজন্য উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে বড় বাজার ধরতে পারছেন না। কমপ্লায়েন্সের উন্নতি হলে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যের রপ্তানি বাড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর জাগো নিউজকে বলেন, এখানে প্রণোদনা কমিয়ে লাভ নেই। এটা কমিয়েও তো আমরা ইউরোপ বা অন্য দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারবো না। কমপ্লায়েন্স ইস্যুর কারণে আমরা বাজার ধরতে পারছি না।
তিনি বলেন, আমরা ট্যানারিশিল্প নগর করেছিলাম সাভারে। কিন্তু ওখানে তো কিছুই হচ্ছে না। ইটিপি ও অবকাঠামো নেই; ফলে চামড়া আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের চামড়াশিল্প নিয়ে কনসার্ন প্রকাশ করা হচ্ছে। সার্টিফিকেশনের সুরাহা যতদিন না হবে, এ চামড়াশিল্পের খুব একটা লাভ হবে না।
এসএম/এমএএইচ/এএসএম