ঈদে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যবসার আশা চট্টগ্রামে
• হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ এসেছে বাজারে
• পাইকারি বাজারে বিক্রি প্রায় শেষ
ঈদুল ফিতর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে বাড়তে শুরু করেছে ক্রেতাদের ভিড়। ঈদের তিন সপ্তাহ বাকি থাকলেও চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারের বিক্রি প্রায় শেষের দিকে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও এবারের ঈদে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যবসার আশা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
শনিবার (২৩ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরের অভিজাত শপিংমল থেকে পাড়ার দোকান সবখানেই ক্রেতাদের ভালো উপস্থিতি ছিল। বিশেষ করে শিশুদের ঈদ কেনাকাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। আর শিশু-অভিভাবকের চাহিদামতো পণ্য সরবরাহে ব্যস্ত সময় পার করেন দোকানিরাও।
চট্টগ্রামের ঈদ বাজারের আকার নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গবেষণা নেই। তবে কয়েক বছর আগে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) জানায়, দেশের ঈদ অর্থনীতির আকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, প্রকৃত হিসাবে শুধু চট্টগ্রামেই এর কাছাকাছি ব্যবসা হয়।
তারা বলছেন, এবার ঈদ উপলক্ষে শুধু চট্টগ্রাম শহরেই ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হবে। এ লক্ষ্যে একেবারে নতুন বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার। তবে, পাইকারি-খুচরা, গ্রাম-শহর মিলে ঈদের লেনদেন ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
‘শবে বরাতের পরপরই পাইকারি পোশাকের বাজারে বেচাকেনা শুরু হয়। এর মধ্যেই পাইকারি বিক্রি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। রমজানের আগে থেকেই চট্টগ্রাম ও আশপাশের আট জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে শুরু করেন। রমজানের প্রথম সপ্তাহেই পাইকারি বিক্রির ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে।’— তামাকুমন্ডি লেন বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক
কাপড় ও জুতার জন্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ঈদবাজার রিয়াজউদ্দিন বাজার। এখানকার ১৫ হাজার দোকানের প্রায় ৫০ শতাংশই পাইকারি বিক্রেতা। এর মধ্যে হাসিনা শপিং, বিনিময় টাওয়ার, রহমান ম্যানশন, প্যারামাউন্ট সিটি এবং সালেহ ম্যানশন কাপড় ও জুতা পাইকারি বিক্রির জন্য এ অঞ্চলে বিখ্যাত। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পোশাক কারখানা ছাড়াও এখানকার ব্যবসায়ীরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও দুবাই থেকে পণ্য আমদানি করেন।
তামাকুমন্ডি লেন বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘শবে বরাতের পরপরই চট্টগ্রামের পাইকারি পোশাকের বাজারগুলোতে বেচাকেনা শুরু হয়। এর মধ্যেই পাইকারি বিক্রি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। রমজানের আগে থেকেই চট্টগ্রাম ও আশপাশের আট জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে শুরু করেন। রমজানের প্রথম সপ্তাহেই পাইকারি বিক্রির ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে।’
আরও পড়ুন
- তরুণদের পছন্দ সুতি ও সিকোয়েন্স পাঞ্জাবি
- ঈদের পোশাকে বৈশাখের ছাপ, ভালো ব্যবসার আশায় দেশি ব্র্যান্ডগুলো
- নেই নতুন ট্রেন্ডি পোশাক, আফগান-নায়রায় ঝুঁকছে ক্রেতারা
তিনি বলেন, ‘করোনা ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক বছর চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবার ঈদের বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসায়ীরা রমজানের এক মাস আগে থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করেন। অনেকে দেশের কারখানায় তৈরি পণ্যও বিক্রি করছেন।’
রেয়াজউদ্দিন বাজারের বিনিময় টাওয়ারের পাইকারি বিক্রেতা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রথম ধাপে ৭০ শতাংশের বেশি কাপড়, জুতা ও অন্যান্য পণ্য বিক্রির জন্য নিয়ে গেছেন। ১৫-২০ রমজানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বিক্রি হবে। অন্যবারের তুলনায় এবার ঈদবাজার ভালো মনে হচ্ছে।’
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাকের বাজার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের টেরিবাজার। ঈদ কেন্দ্র করে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রির আশা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোছাইন বলেন, ‘দেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, দুবাই ও থাইল্যান্ড থেকেও টেরিবাজারের ব্যবসায়ীরা ঈদে বিক্রির জন্য কাপড় নিয়ে এসেছেন। ছোট দোকানগুলো ন্যূনতম ২০ থেকে ৫০ লাখ এবং মেগাশপগুলো কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করেছেন।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি সালেহ আহমেদ সোলায়মান বলেন, ‘পাইকারি বাজার ছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে ১৫টি শপ ও ৫৬টি সাধারণ শপিং সেন্টার রয়েছে। নগর ও জেলায় ১০১টি প্রতিষ্ঠান দোকান মালিক সমিতির অধীনে। ঈদে এসব দোকান ও শপিংমলে আনুমানিক বেচাকেনা হবে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘এবার রমজানের কয়েকদিন আগে থেকেই মানুষ ঈদের কেনাকাটা শুরু করেছে, যা আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক।’
‘পাইকারি বাজার ছাড়াও নগর ও জেলায় ১০১টি প্রতিষ্ঠান দোকান মালিক সমিতির অধীনে রয়েছে। ঈদে এসব দোকান ও শপিংমলে আনুমানিক বেচাকেনা হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা।’— বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি
আখতারুজ্জামান সেন্টার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের মার্কেটে ছোট-বড় ২৬০টি দোকান রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে ছোট দোকানে ২৫-৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং বড় দোকানগুলো ৫০-৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে।’
মিমি সুপার মার্কেট বন্দর নগরীর অন্যতম অভিজাত শপিংমল। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদিন কাঞ্চন জানান, মার্কেটের ২৭৩টি দোকানের প্রায় প্রতিটিতেই এক থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে।
আরও পড়ুন
- মৌচাক-আয়েশা-ফরচুনে বেড়েছে ক্রেতার আনাগোনা
- ব্যস্ততা বাড়লেও বাটিকের গ্রামে মূল্যবৃদ্ধির বাগড়া
- কমেছে ঈদ কার্ড, বেড়েছে ভার্চুয়াল শুভেচ্ছা
ঈদ সামনে রেখে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পছন্দের বাজার নগরের তামাকুমন্ডি লেইন ও জহুর হকার্স মার্কেটও নতুন রূপ নিয়েছে। এ বাজার দুটি সবার কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়, কারণ জামা-কাপড় এবং জুতা থেকে শুরু করে প্রসাধনী, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য এখানে পাওয়া যায়।
ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘আমাদের আওতাভুক্ত ১১০টি মার্কেট রয়েছে। মার্কেটগুলোতে পাইকারি ও খুচরা মিলে ১৫ হাজারের কাছাকাছি দোকান রয়েছে। এখন পর্যন্ত বেচাবিক্রি ভালো। তবে এলসি সংকটের কারণে আমদানিকারকরা ঈদ পণ্য কম এনেছেন। ফলে বাজারে দামের ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে।’
‘এই বিশাল আয়োজনে কত টাকার লেনদেন হচ্ছে তা বলা মুশকিল, তবে আমরা বিশ্বাস করি দেড়শ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। রমজানে প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয় এবং ১৫ রমজানের পর এর পরিমাণ আরও বাড়বে’বলে জানান মোজাম্মেল হক।
এসময় সরকারের কাছে ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধে পদক্ষেপের প্রত্যাশার কথা জানান তিনি। বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা হলো ভ্যাট-ট্যাক্স যেন সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়। প্রায়ই আমাদের ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট সংস্থা দ্বারা হয়রানির শিকার হন, আমরা এ থেকে পরিত্রাণ চাই।’
পাইকারি ও খুচরা বাজার ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরে স্যানমার ওশান শিটি, আফমি প্লাজা, ইউনুস্কো, ফিনলে স্কয়ার, আমিন প্লাজা, চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স, মতি টাওয়ারসহ ৯০টি ছোট-বড় মার্কেটে প্রায় দুই হাজার দোকান ও মেগাশপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে এবারের ঈদে জমজমাট বেচাকেনার প্রত্যাশা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের।
এএজেড/এমএএইচ/এএসএম