বাড়তি দামের তেল আসবে দেড় মাস পর, খবর পেয়েই বাড়ালেন ব্যবসায়ীরা
>>ব্যবসায়ীরা দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বাড়ার প্রভাব
>>বর্ধিত দামের তেল বাজারে আসতে লাগবে দেড়-দুই মাস
নিত্যপণ্যের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। তার ওপর আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বাড়ার অযুহাতে আরেকবার বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। দেশে ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে মাত্র একদিনের ব্যবধানে প্রতিমণ ভোজ্যতেলে ৫০-১৩০ টাকা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বাড়ার প্রভাব পড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করলেও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, বুকিং রেট বাড়লেও বাড়তি দামের তেল বাজারে আসতে কমপক্ষে দেড় থেকে দুইমাস লাগবে। ফলে এখনই দাম বাড়ানো অযৌক্তিক।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩৭ টন ক্রুড সয়াবিন এবং ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৩ টন ক্রুড পাম অয়েল খালাস হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বর্তমানে তিনটি জাহাজ সয়াবিন খালাস করছে। এর মধ্যে ‘মেঘনা ক্রাউন’ ৫৯ হাজার ১০৬ টন, ‘স্টার ক্রিমসন’ ৫১ হাজার ৭৮৫ টান এবং ‘ইয়াশা জুপিটার’ জাহাজে ৪৮ হাজার ৮০৬ টন সয়াবিন রয়েছে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার একদিনের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা বেড়েছে। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকাকেন্দ্রিক মিলের হিসাবে দরের তারতম্য রয়েছে। ঢাকাকেন্দ্রিক মিলগুলোর ভোজ্যতেলের দাম বেশি বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুন
চট্টগ্রামের বাজারে এসআলম, সিটি, আবুল খায়ের গ্রুপের পাশাপাশি মীর গ্রুপের ভোজ্যতেল রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক মেঘনা, সিটি, টিকে এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ভোজ্যতেল রয়েছে। খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের মধ্যে মূলত পাম অয়েল বেশি ট্রেডিং হয়।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, খাতুনগঞ্জে বৃহস্পতিবার প্রতি মণ এসআলম পাম অয়েল ৪৮৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বুধবার এ তেলের দাম ছিল ৪৮১০ টাকা। চট্টগ্রামে সিটির পাম অয়েল ৪৯২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা বুধবার ছিল ৪৮৬০ টাকা।
ঢাকাকেন্দ্রিক আবুল খায়েরের বাটারফ্লাই পাম অয়েল ৪৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একদিন আগে বাটারফ্লাই পাম অয়েলের দাম ছিল ৪৮৫০ টাকা। বৃহস্পতিবার মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের পাম অয়েল বিক্রি হয় ৫০১০ টাকায়। মেঘনার পাম অয়েলের বুধবার দাম ছিল ৪৮৮০ টাকা। ঢাকাকেন্দ্রিক সিটি গ্রুপের পাম অয়েল বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ৪৮৯০ টাকায়। একদিন আগেও এ তেলের দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা কম ছিল।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকাকেন্দ্রিক টি কে গ্রুপের সুপার অয়েল বিক্রি হয়েছে ৫০৮০ টাকায়। বুধবার এ তেলের দাম ছিল ৫০৫০ টাকা। একইভাবে বৃহস্পতিবার মেঘনা গ্রুপের সুপার অয়েল ৫১০০ টাকায় বিক্রি হয়। একদিন আগেও এ তেলের দাম ছিল ৫০১০ টাকা।
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমি বুধবার সকালে মীর পাম নিয়েছি ৪৮১৫ টাকায়, এস আলম নিয়েছিলাম ৪৮০৫ টাকায়। বৃহস্পতিবার দুটিরই দাম ৫০ টাকা করে বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মেসার্স এন আর ট্রেডিংয়ের মালিক মো. ইলিয়াছ জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়ার খবরে বৃহস্পতিবার একদিনেই খাতুনগঞ্জে পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়ে গেছে। ঢাকাকেন্দ্রিক তেলের দাম বেশি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট না কমলে খাতুনগঞ্জের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি।
খাতুনগঞ্জে তেল চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক শাহেদ উল আলম জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে পাম অয়েলের দাম কিছুটা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার পাম অয়েল মনপ্রতি ৪৮৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
তিনি বলেন, দুইদিনের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের বুকিং রেট টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বৃহস্পতিবার রেট ছিল ১০২০ ডলার। এক মাস আগেও ৮৬০ ডলারে ছিল।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকটের মধ্যেও রমজানকে সামনে রেখে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। আমদানি করা এসব পণ্য খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলোতে পৌঁছেও গেছে। এদিকে রমজানের বেশি চাহিদা থাকা পণ্যগুলো ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে পুরোনো আমদানিকারকরা এখন বাকিতেও পণ্য আমদানি করার সুযোগ পেয়েছেন। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিকারকরা বিশেষ এ সুবিধা পাবেন।
পাশাপাশি রমজানকে সামনে রেখে গত ৮ ফেব্রুয়ারি চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েলে আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এর অর্থ, সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো হয়েছে। এ প্রজ্ঞাপনের মধ্যেও বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেনি। পরে সরকার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন খুচরা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ১৬৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বুকিং রেটের অযুহাতে দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের বুকিং রেট বেড়েছে এটি সত্য। কিন্তু রেট বাড়লেও বর্ধিত রেটে এলসি খোলার পর সেই তেল বাজারে আসতে দুই মাস লাগতে পারে।
এখন খবর পেয়েই কেন দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো, প্রশ্ন এ ব্যবসায়ীর।
ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে তখন খবর শুনেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমার সময় তা করেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যবসায়ীবান্ধব, তারা ভোক্তাবান্ধব নয়। যে কারণে ব্যবসায়ীরা যখন মনে করেন তখন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। ব্যবসায়ীদের মর্জির উপর চলতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/এএসএম