ডিজেলের মান পরীক্ষায় বিপিসির ছলচাতুরি!
দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ৩৩৫ মেগাওয়াট সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (এসএমপিসিএল) কাছে কম দামে বিক্রি করা একই ডিজেল পুনরায় চার বছর পর লিটারে ৪০ টাকা বেশিতে কিনেছে বিপিসি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ট্যাংকে পড়ে থাকা এসব অফ-স্পেক ডিজেল ব্লেন্ডিং ছাড়া বাজারে ছেড়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। এসব অনিময় নিয়ে নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ ধাকছে শেষ পর্ব।
সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (এসএমপিসিএল) থেকে ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল গ্রহণ করে বিপিসি। কিন্তু দীর্ঘদিন ট্যাংকে পড়ে থাকায় এসব ডিজেলের রং পরিবর্তন হয়ে যায়, পাওয়া যায় মাত্রাতিরিক্ত সালফারও। বিপিসির ভাষ্যে ‘অফ-স্পেক’ (বিএসটিআই মানমাত্রা অযোগ্য) ঘোষিত এসব ডিজেল বাজারজাত করা নিয়েও মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নেয় বিপিসি। ব্লেন্ডিং ছাড়াই বাজারে ছাড়া হয় এসব ডিজেল। এর আগে পরীক্ষায় নট কমপ্লাই হওয়া এক ট্যাংক ডিজেলের পরীক্ষায়ও ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় বিপিসি।
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদের সই করা প্রতিবেদন, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরীক্ষার দুটি রিপোর্ট এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি স্বাক্ষরিত মন্ত্রণালয়ের সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপির সভাপতিত্বে আয়োজিত ২০২৩ সালের ২ নভেম্বরের ওই সভায় বিপিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘সামিট, পিডিবি, বিপিসি, তেল বিপণন কোম্পানি ও সার্ভেয়ারের উপস্থিতিতে সামিটের ১৬ ট্যাংক থেকে ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ডিজেল গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিন ট্যাংকে থাকার কারণে সামিটের ডিজেলের রং কিছুটা বিবর্ণ হওয়ায় এবং সালফারের পরিমাণ কিছুটা বেশি থাকায় তা বিপিসির আমদানি করা উচ্চমানের ডিজেলের সঙ্গে ব্লেন্ড করে বিএসটিআই মানে উন্নীত করে বিক্রি করা হয়েছে।’
মন্ত্রণালয়ের সভায় গ্রহণ করা ডিজেল ব্লেন্ড করে বিক্রির কথা বলা হলেও মূলত এসব ডিজেল ব্লেন্ড করা ছাড়াই ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে ছেড়েছে বিপিসি। পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ডিপো এবং যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপোর মাধ্যমে এসব ডিজেল গ্রহণ করে বিপিসি। ওই তিন ডিপোতে ব্লেন্ডিং করার সুযোগ নেই। বিষয়টি ডিপোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
২০২৩ সালের ২০ আগস্ট বিপিসিকে দেওয়া পিডিবির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার থেকে পদ্মা অয়েলের গোদনাইল ডিপোতে ৬ জাহাজে ১ কোটি ১২ লাখ ১ হাজার ৮৬৪ লিটার, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ডিপোতে ৫ জাহাজে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৩০২ লিটার এবং যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপোতে ৫ জাহাজে ৯৮ লাখ ৭১ হাজার ৫৫৩ লিটার মিলে ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল সরবরাহ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন>> কাজে লাগবে না, তবুও ‘জ্ঞান নিতে’ বিদেশ যাচ্ছেন কর্মকর্তারা
পদ্মা অয়েলের গোদনাইল ডিপোর ম্যানেজার (অপারেশন্স) পেয়ার আহমদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানি না। আমি গোদনাইল ডিপোতে গত ২ জানুয়ারি জয়েন করেছি। আমরা চিটাগং থেকে যেগুলো ফিনিশড প্রোডাক্ট পাই, তা বিক্রি করি। ব্লেন্ডিং রিফাইনারি সবই চিটাগাংয়ে করে। আমরা করি না।’
সামিট থেকে ডিজেল গ্রহণের সময় পদ্মা অয়েলের গোদনাইল ডিপোতে পদায়িত ছিলেন সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অপস) মো. শাহজাহান কবির চৌধুরী। জানতে চাইলে গোদনাইল ডিপোতে ব্লেন্ডিং সুবিধা নেই বলে জানান তিনিও।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের গোদনাইল ডিপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) মো. লুৎফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মেঘনার গোদনাইল ডিপোতে ব্লেন্ডিং সুবিধা নেই। বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী সামিট থেকে তেল নেওয়া হয়েছিল। এগুলো আমাদেরই তেল ছিল। সামিট থেকে নেওয়ার পর এগুলো আবার ডিলারদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে।
অন্যদিকে যমুনা অয়েলের ফতুল্লা ডিপো ম্যানেজার শেখ জাহিদ আহমেদ বলেন, ‘আমি ফতুল্লায় জয়েন করেছি মাত্র একদিন হলো। কোনো বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারবো না।’
আরও পড়ুন>> প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের সড়কে ‘নিম্ন’ গ্রেডের বিটুমিন
এ ব্যাপারে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপণন কোম্পানিগুলোর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, জ্বালানি তেল রিফাইন কিংবা ব্লেন্ডিং করার সুযোগ চট্টগ্রামের বাইরে কোনো ডিপোতে নেই। কিন্তু সামিটের কাছ থেকে গ্রহণকৃত ডিজেল চট্টগ্রামে নেওয়া হয়নি। এগুলো গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপো থেকেই ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল।
‘নট কমপ্লাই’ ডিজেল যেভাবে হয়ে যায় ‘কমপ্লাই’
সামিটের ডিজেল গ্রহণ নিয়ে বিপিসির কমিটি সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্টের আটটি (৭-১, ৭-২, ৭-৩, ২-১, ২-২, ২-৩, ২-৪ এবং ২-৫) ট্যাংক থেকে ডিজেলের আলাদা আলাদা স্যাম্পল (নমুনা) সংগ্রহ করে। পৃথক বোতলে ভর্তি এসব স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পাঠানো হয়। স্যাম্পল পরীক্ষা শেষে ৩১ জানুয়ারি বিপিসিকে রিপোর্ট দেয় ইআরএল।
পরীক্ষায় ‘২-৫’ ট্যাংকের স্যাম্পলে ‘এএসটিএম ডি ৮৬’ মানটি ৩৭০.৯ পাওয়া যাওয়ায় “নট কমপ্লাই” রিপোর্ট দেওয়া হয়। বিএসটিআই মান অনুযায়ী ‘এএসটিএম ডি ৮৬’ মান সর্বোচ্চ ৩৬৫ হওয়ার কথা। তবে পরীক্ষায় অন্য স্যাম্পলগুলো কমপ্লাই হয়।
এতে বিপিসির কমিটি প্রথমে ওই ট্যাংকের (২-৫) ডিজেল গ্রহণ না করার বিষয়ে মত দেয়। পরে আবার গ্রহণ করার জন্য নতুন কৌশল প্রণয়ন করে বিপিসি। এবার সবগুলো ট্যাংকের স্যাম্পল ব্লেন্ডিং করে একটি ‘এএসটিএম ডি ৮৬’ মান বের করার সিদ্ধান্ত নেয় বিপিসি। যাতে নির্ধারিত মানের অন্য সাতটির সঙ্গে মিশে ‘নন কমপ্লাই’ ট্যাংকটিও কমপ্লাই করা যায়।
কৌশল অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল ইআরএলকে পুনরায় স্যাম্পল পরীক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন কমিটির আহ্বায়ক। আগের পরীক্ষায় ‘২-৫’ ট্যাংকের স্যাম্পলে এএসটিএম ডি ৮৬’ মান ‘নট কমপ্লাই’ হওয়ার কথা উল্লেখ করে চিঠির একটি অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের প্ল্যান্ট থেকে সংগৃহীত ডিজেলের ৮ বোতল নমুনা পুনরায় বেল্ডিং করে শুধু ‘এএসটিএম ডি ৮৬’ মানটি পরীক্ষণের বিষয়ে বিপিসি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে।
আরও পড়ুন>> ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি নিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যানের বোর্ড মিটিং!
যথারীতি সবগুলো বোতলের স্যাম্পল ব্লেন্ডিং (একত্রে মেশানো) করে ‘এএসটিএম ডি ৮৬’ মান ৩৬৪.৭ পায় ইআরএল। এতে বেল্ডিংকৃত স্যাম্পল ‘কমপ্লাই’ উল্লেখ করে ২০২৩ সালের ৭ মে বিপিসিকে রিপোর্ট দেয় ইআরএল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইস্টার্ন রিফাইনারির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, বিপিসি থেকে আমাদের যেসব স্যাম্পল দেওয়া হয়, সেগুলো বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়া হয়। সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার প্ল্যান্টের ডিজেল পরীক্ষার ক্ষেত্রে ৮টি পৃথক বোতলে ডিজেলের স্যাম্পল দেওয়া হয় পরীক্ষার জন্য। আলাদা আলাদা বোতলের ডিজেল পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরবর্তীসময়ে বিপিসি পৃথক চিঠিতে আবার আট বোতল ডিজেল একত্রে ব্লেন্ড করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। এরপর আমরা ব্লেন্ড করার পর যে মাত্রা পাওয়া গেছে তার প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতামত
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠানের ডিজেল কেনা হয়েছে, তাদের কেউ নিয়ন্ত্রণ করেন না। তারাই পিডিবি, বিপিসিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যে কারণে অফ-স্পেক কিংবা সালফারযুক্ত ডিজেল আবার বেশি দামে কিনতে হয়েছে বিপিসিকে। এখানে সরকারি টাকায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে এসব ডিজেল বিক্রয় মূল্যে ফেরত না নিয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে। পিডিবি এবং বিপিসি দুটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান লাভবান না হলেও এক্ষেত্রে পিডিবি কিংবা বিপিসির কতিপয় কর্মকর্তা ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যেই এ কাজটি করেছেন। না হলে বিপিসির চেয়ারম্যান যেখানে জ্বালানি সচিবকে চিঠি দিয়ে নিজেদের কমিটির সুপারিশকৃত দামকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে উল্টো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এই সাফাই গাওয়ার মধ্যেই ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্য জড়িত।
তিনি বলেন, প্রথমে নট কমপ্লাই হওয়ার পর পরে কমপ্লাই হওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই অনিয়ম রয়েছে। এসব অনিয়মে যারাই জড়িত তাদের যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা উচিত।
বিপিসি যা বলছে
সামিট থেকে কেনা ডিজেল নিয়ে সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে এবং হোয়াটস অ্যাপে খুদে বার্তা দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
সর্বশেষ এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য চেয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর পৌনে ১২টায় বিপিসি চেয়ারম্যানের দাপ্তরিক ইমেইলে মেইল করা হয়। সে মেইলেরও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
অফস্পেক ডিজেল বাজারজাত করার বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এগুলো বিতরণ কোম্পানি বলতে পারবে। কারণ তারাই এসব বাজারজাত করেছেন।
নট কমপ্লাই হওয়া স্যাম্পল কমপ্লাই করার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথম পরীক্ষার রিপোর্টের পর বিষয়টি আমিই প্রথম ধরেছিলাম। পরে পুনরায় পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরের পরীক্ষায় কমপ্লাই রিপোর্ট এসেছিল।
তবে প্রথমে পৃথক পৃথক স্যাম্পল পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করা হলেও পরবর্তীসময়ে সবগুলো স্যাম্পল ব্লেন্ডিং করে পরীক্ষার বিষয়ে বিপিসি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তা সম্পর্কে তিনি অবগত নন বলে জানান।
ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/এএসএম