সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ শত্রু-মিত্র চেনা

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৬ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ হাসিনা। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবারও। এরই মধ্যে মন্ত্রিসভাও গঠন হয়েছে এবং সরকারকে অভিবাদন জানাচ্ছে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।

এবার বেশকিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন মেয়াদ শুরু করছে আওয়ামী লীগ। আপাতত অর্থনৈতিক সংকট নিয়েই নানান আলোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, মূল্যস্ফীতির সংকট এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোকপাত করছেন বিশিষ্টজনরা।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবিলার প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে মতামত গ্রহণ করা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমি বলব আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচন ভালো হয়েছে। পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ এবং বিশ্ব সমাজে খুবই সমাদৃত।’

আরও পড়ুন>> ‘গোষ্ঠীস্বার্থের ভূত চেপে বসার কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না’ 

চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমি মনে করি, বর্তমান সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শত্রু-মিত্র চেনা। আমরা সাধারণত পণ্য কিনি চীন, রাশিয়া ও ভারতবর্ষ থেকে। অন্য জায়গা থেকেও কেনা সম্ভব। এর মধ্যে ভারত আমাদের ভালো এবং বড় প্রতিবেশী।

আর বেচা-বিক্রি করতে হয় উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে। শ্রমসেবা বিক্রি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকায়। ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য বিক্রি করতে না পারলে বড় বিপদ।

আমরা যে আর্থিক সহযোগিতা পাই সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের পাবলিক খাতে ঋণ হচ্ছে ৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ রয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব এবং যার মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যও কিছু আছে।

কাজেই এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি নীতিকৌশল অবলম্বন করা দরকার। আমি মনে করি, সরকারের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে আমরা চলতে পারবো কি না সন্দেহ আছে।’

 

এখনো খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সেটা অপ্রতুল বলে মনে করছি। মানুষ বাঁচাতে হলে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। তিন মাস থেকে যতদিন প্রয়োজন ততদিন নিত্যপণ্য বিক্রি করতেই হবে। এতে যারা পণ্য মজুত করে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করেন তারা শায়েস্তা হয়ে যাবেন। সরকার পণ্য বিক্রি বাড়িয়ে দিলে তাদের মজুত ছাড়তে বাধ্য হবে। নইলে গুদামে পচবে।

 

এ বিশ্লেষক টাকার মানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, টাকার মান রক্ষার চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে তীব্র হচ্ছে। আমরা বারবার বলার পরেও কৃত্রিমভাবে বাঁধিয়ে রাখা হলো। ফলে ৩০ শতাংশ মান কমে গেলো। টাকার মান রক্ষা করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতিশীল করতে হবে। এটি করার জন্য মুদ্রা পাচার ঠেকাতে হবে। আইএমএফ বা জাতিসংঘও বলছে বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়। এর সঙ্গে ঋণখেলাপ এবং করখেলাপ একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এটি সংস্কার করা অতিজরুরি।’

সংস্কার সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এ সংস্কার সম্ভব এবং করা উচিত। ছয় বছর আগে বড় ধরনের মূলধন আমদানির নামে মুদ্রা পাচার হচ্ছিল। যে প্রবীণ কর্মকর্তা এটি ধরেছিলেন, তার চাকরি যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। কাজেই সরকারকে মনস্থির করে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমি মুদ্রাপাচার রোধ করব কি না।’

আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, বাংলাদেশে আড়াই কোটি মানুষের কাছে পাঁচ হাজার ডলার আয় রয়েছে। সরকারের এই ব্যক্তিদের বন্ধুত্বপূর্ণভাবে খুঁজে বের করা এবং করের আওতায় আনতে হবে। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারের ব্যাংক খাতের গ্রামার এবং পুনঃতফসিলের যে ব্যবস্থা ছিল তা ফিরিয়ে আনতে হবে। ঋণ আদায়, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে এক পরিবারের কতজন সদস্য, কতদিন থাকবে এ বিষয়গুলো সংস্কার করতে হবে।’

আরও পড়ুন>> ‘আমেরিকা বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার বসাতে চেয়েছে’ 

নতুন সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতিকেও বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় টিসিবি সৃষ্টি। ব্যাপকভাবে আমদানি করে দুস্থদের প্রায় বিনামূল্যে পণ্য বিরতরণ করা হয়। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তায় পল্লীবিদ্যুৎ এবং পোল্ট্রি খাবারের সংস্থান করে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি, ১৯৯৮ সালে ব্যাপক বন্যার পরে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা এবং বিশিষ্ট বিশ্ব নেতা বলে বিবেচিত শেখ হাসিনা দেড় কোটি মানুষকে ৯ মাস ধরে খাইয়েছিলেন ভিজিএফের মাধ্যমে। ১০ লাখ টন খাদ্যপণ্য মজুত করা হয়েছিল এবং খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা হয়।

এখনো খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সেটা অপ্রতুল বলে মনে করছি। মানুষ বাঁচাতে হলে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। তিন মাস থেকে যতদিন প্রয়োজন ততদিন নিত্যপণ্য বিক্রি করতেই হবে। এতে যারা পণ্য মজুত করে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করেন তারা শায়েস্তা হয়ে যাবেন। সরকার পণ্য বিক্রি বাড়িয়ে দিলে তাদের মজুত ছাড়তে বাধ্য হবে। নইলে গুদামে পচবে।

এখানে আমি আরেকটি বিষয় সুপারিশ করবো, যদি কোনো পণ্য আমদানির পাঁচটি লাইসেন্স থাকে সেখানে বাড়িয়ে একশটি লাইসেন্স করতে হবে। আমদানিকারক বাড়াতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আসবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময় আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলাম।

আমি একজন ক্ষুদ্র অংশ ছিলাম তখন। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম। কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। অর্থমন্ত্রী শাহ এসএম কিবরিয়া সাহেব। আমরা একটি টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলাম অত্যন্ত সফলভাবে। তখন মূল্যস্ফীতি ছিল সাধারণভাবে ৫ বছরে ২ শতাংশ। আর ২০০১ সালে ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ।’

আরও পড়ুন>> ‘ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো শিখছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে’ 

এখনকার বাস্তবতায় সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হতে পারে। ২ শতাংশ হয়তো ভাবনা করা ঠিক হবে না। গত এক বছরে বিশ্বের প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মুদ্রানীতি ও সুদের হারের তারতম্য ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষম হয়েছে। পাশের দেশ শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি ৬৯ শতাংশ থেকে মাইনাস ১ দশমিক ৫ শতাংশ করেছে। ভারত কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপেও কমেছে। পারেনি শুধু বাংলাদেশ আর পাকিস্তান।’

মূল্যস্ফীতি না কমার কারণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক নীতিনির্ধারক বলছেন সুদের হার দিয়ে নাকি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ কারণেই সুদের ৬/৯ হার জোর করে রাখা হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে মূল্যস্ফীতি না ঘটালে নাকি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না।

আমি অনেক বছর লেখাপড়া করেছি। পিএইচডি করেছি। অনেক জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছি। আমার অনেক গবেষক বন্ধু রয়েছেন। এ ধরনের উদ্ভট বক্তব্য কেউ মানতে পারবেন না। আমরা কোথাও শুনিনি। সুদের হার বাড়াতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটু বাড়িয়েছে এখন। তবে জটিল ফর্মুলায়, যা বোঝা যায় না।

 

সরকার কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তা দেখার আছে। বারবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারির অজুহাত বা অন্য কোনো কারণ সামনে এনে দায় এড়ানো যাবে না। সরকারকে অর্থসন্ত্রাসদের অত্যন্ত কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। কারণ দুর্নীতিই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, যদি নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকে।

 

আমি একদম উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পারি, সুদের হার বেশি থাকলে প্রোডাক্টিভ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সেখান থেকে ঋণ নেয় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। আর সুদের হার যদি কম থাকে তাহলে মুদ্রাপাচারকারী এবং খেলাপিরা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। এখনো সময় আছে পলিসি গ্রহণ করার। কারণ, আগে সফলতার উদাহরণ আছে।’

সরকারের নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘যাকে অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি অর্থনীতির ভালো ছাত্র ছিলেন। আমরা একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছি। একসঙ্গে সরকারি চাকরিতেও যোগদান করি। তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডারে এবং আমি প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেই। আমরা পাঞ্জাবিদের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে মারামারি করেছি বাঙালিদের অধিকার আদায়ে। ১৯৬৬ সালের কথা। আমাদের চাকরি টিকেছে শুধু বঙ্গবন্ধুর কারণে। ৬ দফা জোরদার না হলে চাকরিই থাকতো না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রবল সাহসী প্রবক্তা আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি সামলে আনতে পারবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

তবে সরকার কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তা দেখার আছে। বারবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারির অজুহাত বা অন্য কোনো কারণ সামনে এনে দায় এড়ানো যাবে না। সরকারকে অর্থসন্ত্রাসদের অত্যন্ত কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। কারণ দুর্নীতিই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, যদি নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকে।’

এএসএস/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।