সমাজে বৈষম্য কমাতে ত্রিভুজ ক্ষমতার বলয় ভাঙার তাগিদ

দেশ অনেক এগিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে, কমেছে দারিদ্র্যের হার। কিন্তু সে হারে দেশের মধ্যে বৈষম্য কমেনি। এ বৈষম্য কমাতে হলে দুর্নীতি দমনের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের ত্রিভুজ ক্ষমতার বলয় সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। এমন অভিমত অর্থনীতিবিদদের।
শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে দ্য বিজনেস আই।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও বিজনেস আই পত্রিকার সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন এতে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জমান, ড. জাহাঙ্গীর আলম, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রমুখ।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বলতে সব নাগরিকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কেউ পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু ’৭১ পরবর্তী আমাদের আয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, তবে বৈষম্য কমেনি। আমাদের এই বৈষম্য কমাতে হলে গ্রামে বিনিয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। রাজনীতিবিদ, আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ীর ত্রিভুজ ক্ষমতার বলয় ভাঙতে হবে। আমাদের শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এসব করতে পারলে তবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব।
ড. কাজী খলিকুজ্জমান বলেন, এই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এটা আমাদের ঐতিহ্যে ছিল, স্বাধীনতার ইশতেহারে ছিল। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের এজেন্ডায় টেকসই বলতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আমাদের উন্নয়ন হয়েছে আবার বৈষম্য বেড়েছে। এটা কমাতে হলে শুধু ক্যাশ টাকা দিলেই গরিবের উন্নয়ন হবে না, বৈষম্য কমবে না। টাকা অবশ্যই প্রাথমিক উন্নয়নের একটা ধাপ। এর সঙ্গে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, দক্ষ করতে হবে। একজন মানুষ একটা পণ্য উৎপাদন করছে, সে কীভাবে বিক্রি করবে সেটাও দেখাতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের মূল্যবোধের বিরাট অবক্ষয় হয়েছে। আমরা আমি থেকে ‘আমরা’ হতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্য। আমাদের এখানে দুষ্টুচক্র আছে। তাদের হাত অনেক লম্বা, তাদের দমন করতে হবে। তাদের কারণে বৈষম্য বাড়ছে। এখন মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এতে বৈষম্য বেড়ে পয়েন্ট পাঁচ-এ চলে এসেছে। আরও বাড়তো, তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এটা খুব বেশি হতে পারেনি।
ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের রেমিট্যান্স বেড়েছে। ৭২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। দেশের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়ার কারণে বৈষম্য কিছুটা বেড়েছে। তবে বৈষম্য কমাতে সরকার সামাজিক সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। গরীবদের মধ্যে নগদ টাকার হার বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিভিন্ন ভাতা বাবদ নিম্ন আয়ের মানুষ পেয়ে থাকেন। এখন সুযোগের সমতা এসেছে। বড় চাকরির ক্ষেত্রে কোটা নেই, যেটা একপ্রকার অন্যায়ই ছিল। এর ফলে মেধাবীরা বিসিএসে চলে আসছেন।
তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে পারিনি দুর্নীতির কারণে। এই বৈষম্য কমাতে দুর্নীতি কমাতে হবে। একইভাবে ন্যায্যভাবে ট্যাক্স দিতে হবে। সরকার আগামীতে দুর্নীতি নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে। আমাদের পরিকল্পনায় ছিল এ বিষয়ে, তবু আগামীতে সরকার আরও কঠোর হবে। ঋণ খেলাপি, বিল খেলাপি উভয়কেই ধরবে সরকার। আমি সরকারে এখন নেই, তবে আগামী আট-দশদিন পর যে সরকার আসবে সে সরকার অবশ্যই এ নীতির কঠোর প্রয়োগ করবে।
সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, গত ৫০ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার সিংহভাগই হয়েছে ১৫ বছরে। এই দেড় যুগে দেশ অনেক এগিয়েছে। ম্যাক্রো ইকোনমিক উন্নয়নের শক্তি জুগিয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামীর উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় নীতি সুদহার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বললে আমি বলবো এটা হয়েছে। আমাদের পোশাক খাতের দুই কাঁচামালের একটি কটন বা তুলা, অপরটি প্রেট্রোকেমিক্যাল। এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ তুলা আমাদের এখানে উৎপাদন হয়, বাকি ৯৮ শতাংশ আসে আমদানি থেকে। আর প্রেট্রোকেমিক্যাল শতভাগ আমদানি করা হয়। এর পরও আমরা কটনের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দুই নম্বরে, ডেনিম ও নিটওয়্যারে এক নম্বরে আছি আমরা। সরকারের সহযোগিতায় এটা সম্ভব হয়েছে, এনবিআরসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা পেলেই আরও এড়িয়ে যেতে পারবো।
তিনি বলেন, অনেকেই অভিযোগ করে বলেন আমাদের পোশাক কারখানা থেকে বিদেশিরা কাজ করে নাকি বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যান। এটা মিথ্যা অভিযোগ। আমাদের এখানে দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে, তবে সেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এখন বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষরা বেরিয়ে আসছেন। এতে আমাদের গ্যাপ পূরণ হচ্ছে। বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও করা হবে, যেখানে দক্ষ জনশক্তি আসবে।
ইএআর/কেএসআর/এএসএম