হরতাল-অবরোধ
বিক্রি তলানিতে, ধুঁকছে ব্র্যান্ড হাউজগুলো
বছরের শেষ দিকে ক্লিয়ারিং সেল, ভিন্নধর্মী নানা অফার কিংবা বড় অঙ্কের ছাড় দেয় ব্র্যান্ড হাউজগুলো। এসব বিশেষ ছাড়ের আশায় ক্রেতারাও ভিড় করেন ব্র্যান্ড হাউজগুলোতে। প্রতি বছরের এই সময়ে বিক্রিও জমে ওঠে। তবে এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবকিছুই ওলটপালট করে দিয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। টানা হরতাল-অবরোধে অন্য খাতের মতো একদমই বেচাকেনা নেই ব্র্যান্ড হাউজগুলোতে। রীতিমতো টিকে থাকার জন্য লড়ছে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
তৈরি পোশাক, জুতা, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকসসহ নানান ধরনের পণ্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ড হাউজ ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ তথ্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, একদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অন্যদিকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমেছে। কোনো কোনো খাতের তারচেয়েও বেশি। বছর শেষে আগের মজুত পণ্য খালি করার জন্য ছাড়সহ আকর্ষণীয় নানা অফার দিয়েও ক্রেতার সাড়া মিলছে না।
আরও পড়ুন>> ‘বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে, ঘরে বসে থাকলে তো আর পেট ভরবে না’
তারা বলছেন, প্রায় এক মাস ধরেই কোনো বেচাবিক্রি নেই। বেচাবিক্রি না থাকলেও সারাদেশে শত শত শোরুমের ভাড়া, সার্ভিস চার্জসহ পরিচালন ব্যয় টানতে হচ্ছে আগের মতোই। বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে এই মুহূর্তে টিকে থাকাটাই হাউজগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘বেচাবিক্রি না থাকলেও সারাদেশে শত শত শোরুমের ভাড়া, সার্ভিস চার্জসহ পরিচালন ব্যয় টানতে হচ্ছে আগের মতোই। বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে এই মুহূর্তে টিকে থাকাটাই হাউজগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে’
এ বিষয়ে কথা হয় ফ্যাশন হাউজ ‘সাদাকালো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল হক আজাদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বছরের এ সময়টা বেচাবিক্রির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি ক্রেতারা আসতেন, পর্যটক থাকতো, দেশেও অনেক আচার-অনুষ্ঠানে ভালো বিক্রি হতো। এছাড়া উইনটারে (শীত) নতুন ধাচের পোশাকের বড় বাজার ছিল। কিন্তু সবকিছু ভেস্তে গেছে এ হরতাল-অবরোধের কারণে।’
তিনি বলেন, ‘বছরজুড়ে প্রায় সবার প্রোডাক্ট আটকে রয়েছে। কিন্তু ক্রেতা নেই। মানুষ আর যাই করুক, এ হরতাল-অবরোধ ভেঙে পোশাক কিনতে আসে না। এখন প্রায় ক্রেতাশূন্য আমাদের শোরুমগুলো, যা বিক্রি হয়, তা দিয়ে আসলে কিছুই হচ্ছে না।’
আরও পড়ুন>> অবরোধে ‘প্রায় ফাঁকা’ নিউমার্কেট, চিন্তিত ব্যবসায়ীরা
আজহারুল হক আজাদ আরও বলেন, ‘অনেক সময় সহিংসতার ভয়ে কিছু এলাকায় শোরুম বন্ধ থাকছে। এমনিতেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা ছিল বেশকিছু সময়, যে কারণে খরচ বাড়লেও মূল্যছাড় দিয়ে পোশাক বিক্রি করে আয়ের চেষ্টা চালাচ্ছিল আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। সেটাও এখন হচ্ছে না। সার্বিকভাবে বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।’
পোশাকের ফ্যাশন হাউজ মালিকদের সংগঠন ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ লোক সরাসরি কাজ করেন। পরোক্ষভাবে যুক্ত লোকজনের হিসাব করলে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে এ খাতসংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এখন।’
একই সঙ্গে প্রান্তিক কারুশিল্পী ও বয়নশিল্পীরাও এ খাতের সঙ্গে জড়িত। কারুশিল্পী ও বয়নশিল্পীদের মজুরি সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হয় বছরের শেষে। কিন্তু এবার শেষ সময়ে বিক্রি না থাকায় সে অর্থে টান পড়বে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক না হলে অনেক ফ্যাশন হাউজ তাদের আউটলেটের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলবে বলে জানানো হয়েছে।
‘এখন বিক্রি না থাকায় পুঁজি ভেঙে শোরুমের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল দিতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান দিলে কয়েক মাসের মধ্যে শোরুম বন্ধ করতে হবে।’
রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধারা সিটি এবং বেইলি রোডে কয়েকটি শোরুম চালাচ্ছেন এমন একজন তরুণ উদ্যোক্তা ‘জিপাস’র কর্ণধার হুসাইন ইমতিয়াজ। ব্যবসার পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন বিক্রি না থাকায় পুঁজি ভেঙে শোরুমের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল দিতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান দিলে কয়েক মাসের মধ্যে শোরুম বন্ধ করতে হবে।’
আরও পড়ুন>> আকাশপথেও অবরোধের প্রভাব, কমেছে যাত্রী-টিকিট বিক্রি
তিনি বলেন, ‘টানা হরতাল-অবরোধ পুরো অর্থনীতির বড় ক্ষতি করে দিয়েছে। আমাদের যেসব ভেন্ডরসহ অন্যান্য সহযোগী রয়েছে, তারাও আর্থিক সংকটে রয়েছে। কোনো সাপোর্ট দিতে পারছে না, বরং পাওনার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠান তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যারা স্বল্পসময়ে ব্যবসা প্রসারিত করেছি, তাদের মধ্যেও অনেকেরই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। উপায় নেই এখন।’
তৈরি পোশাক, জুতা, কসমেটিকসের মতো চলতি হরতাল-অবরোধে বিক্রি কমেছে ফার্নিচার ইলেকট্রনিকসহ অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রীর। সরেজমিনে রামপুরা থেকে মালিবাগ এলাকায় বেশকিছু গৃহস্থালি সামগ্রীর দোকানে ঘুরে, মালিকদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, হরতাল-অবরোধে তাদেরও তেমন বেচাবিক্রি নেই। সীমিত পরিসরে দোকানপাট খোলা হলেও বেচাবিক্রি একেবারেই কম। ফলে বড় ধরনের সংকটে পড়েছেন তারা। অনেকে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।
হাজিপাড়ার মঈন ফার্নিচারের কর্ণধার মঈন উদ্দিন বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন বিক্রির ধারেকাছেও নেই। আমাদের বিক্রয়কেন্দ্রে আসবাবপত্র বিক্রি ভয়াবহভাবে কমে গেছে। মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ফার্নিচার কিনতে আসছেন না। কেউ কেউ এলেও ঝুঁকির কারণে পরিবহনও করতে চাচ্ছেন না।’
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক উত্তাপে হোটেল ব্যবসায় ধস, পর্যটন খাতে বড় ধাক্কা
ফার্নিচার খাতের উদ্যোক্তারা জানান, দেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ফার্নিচারের বাজার রয়েছে। একসময় দেশে প্রচুর ফার্নিচার আমদানি হলেও এখন স্থানীয় উদ্যোক্তারা ৯৫ শতাংশ পূরণ করছেন। তবে গত এক মাসে ফার্নিচার বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। অন্যদিকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশি ফার্নিচার। বর্তমানে ১১০ থেকে ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফার্নিচার রপ্তানি হচ্ছে প্রতি বছর। চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কাঁচামাল আমদানিতে সংকট তৈরি হয়েছে, যা প্রভাব ফেলছে রপ্তানিতেও।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান এবং হাতিল ফার্নিচারের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাপরবর্তী সময়ে অর্থনীতির খারাপ অবস্থায় ফার্নিচার বিক্রি অনেকটা কমেছিল। এরপর ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে অনেক। এ সমস্যায়ও সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হয়েছে। তার নেতিবাচত প্রভাবও পড়েছে এ খাতে। এর মধ্যে হরতাল-অবরোধে আমাদের বিক্রি একদম কমে গেছে। পুরো ফার্নিচার সেক্টর খুব বাজে অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন>> ট্রাক চলছে বাড়তি ভাড়ায়, বাড়ছে পণ্য পরিবহন খরচ
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন দেশে অর্ধেকের কম ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে। যেখানে আমাদের প্রতিটি শোরুমের প্রচুর ভাড়া এবং পরিচালন ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। আমরা লোকসানে পড়েছি।’
ওয়ালটন প্লাজার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমাদের গাজীপুরের সেলস সেন্টারে আগুন দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি টাকার পণ্য নিয়ে আমরা উদ্বেগের মধ্যে ব্যবসা করছি। অনেক সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ব্যবসায়ীরা আক্রমণের পরিণত হয়েছেন। এটা খুব খারাপ বিষয়।’
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্ব এখনো ধুঁকছে। ডলারের উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতিতে টালমাটাল অর্থনীতি। বৈশ্বিক প্রভাব বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে বাংলাদেশও। রিজার্ভে টান, রপ্তানি আয়ে ভাটার পাশাপাশি নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে হরতাল-অবরোধ। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য একদম স্থবির হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকশূন্য রাঙ্গামাটি
অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য সারাদেশে পৌঁছাতে পারছেন না। সে কারণেও বিক্রিতে ভাটা পড়েছে বলে জানান তারা।
আবার হরতাল-অবরোধে পরিবহন সংকটে বিভিন্ন বন্দরে আটকেপড়া কাঁচামালও সংগ্রহ করতে পারে না ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ব্যাহত হয় উৎপাদন, যার প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতেও। বাংলাদেশ থেকে পোশাক, ফার্নিচারের মতো নানান রপ্তানি পণ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
আরও পড়ুন>> হরতাল-অবরোধে বাড়ছে উদ্বেগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস
এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে। যারা এমন উদ্বেগের রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছেন, এটা ঠিক নয়। কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দলকে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। যে কর্মসূচি অর্থনীতি আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা আমাদের প্রত্যাশিত নয়।’
আরও পড়ুন>> অর্থনীতির স্বার্থে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির
মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা চাই বিগত কয়েক বছরের মতো শান্তিপূর্ণ ধারায় আন্দোলন হোক। ব্যবসায়ীরা সবসময় শান্তিপূর্ণ অবস্থা আশা করে। তবেই দেশের অর্থনীতির চাকা চাঙা থাকবে।’
বুধবার (২২ নভেম্বর) থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দগুলোর সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বাত্মক ষষ্ঠ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পুলিশি অভিযানে পণ্ড হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে পরদিন ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সর্বাত্মক সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় দলটি। এরপর সারাদেশে পাঁচ দফায় সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।
এনএইচ/ইএ/জেআইএম