আইএমএফের শর্ত
রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হলেও কর অব্যাহতি কমাতে কিছুটা সফল এনবিআর
শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরই মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করেছে সংস্থাটি। ঋণের শর্তানুযায়ী, বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানোসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে আইএমএফের শর্ত থাকলেও বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এছাড়া আর্থিক খাতে সংস্কার না হওয়া, খেলাপি ঋণসহ সবকিছু মিলিয়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে রয়েছে সংশয়।
সূত্র জানায়, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক বা তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। আলোচ্য সময় ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি ৮ হাজার ১৯৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৯৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।
গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে আদায় হয়েছিল ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। যদিও আইএমএফের শর্ত মেনে কর অব্যাহতি কমাতে কিছুটা সফল এনবিআর। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে দেওয়া শুল্ককর অব্যাহতি।
আরও পড়ুন: এনবিআরে বিপিসির বকেয়া জেনে ‘অবাক’ আইএমএফ
এই তিন মাসে ১২ হাজার ৭৩ কোটি টাকা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ৮২ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে এই অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড ৫১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দিয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও ৯ হাজার ১৫২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬১ হাজার ৩২ কোটি টাকা কর অব্যাহতি দিয়েছিল এনবিআর। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমীক্ষা অনুযায়ী, কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধার কারণে কর-জিডিপির অনুপাত ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে। এই সুবিধা তুলে দিলে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে দাঁড়াবে। তবে চাইলেই অব্যাহতি তুলে দিতে পারে না এনবিআর।
কর অব্যাহতির বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি কমানো নিয়ে আইএমএফের একটা চাপ আছে। সেই চাপে নয় বরং নিজেদের স্বার্থেই আমরা অব্যাহতির পরিমাণ কমিয়ে এনেছি। আরও কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে কাজ হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতার থেকে উন্নত দেশে পৌঁছে যাচ্ছি। অথচ ছোট ছোট বিষয়ে ব্যবসায়ীরা কর অব্যাহতির আবেদন করে থাকেন। যা অত্যন্ত বিব্রতকর। শিল্পের উন্নতি ও নানা কারণে কর অব্যাহতি আমাদের দিতে হচ্ছে। তব ব্যবসায়ীদের স্বাবলম্বী করতে ও করের পরিমাণ বাড়াতে আমরা অব্যাহতি কমানোর চেষ্টা করছি। অনেক সময় সরকারি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অব্যাহতি দিতে হয়। আবার পণ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এসব কারণে কর অব্যাহতি পুরোপুরি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: মতামত না নিয়ে আইএমএফের অর্থ ব্যবহার করলে বৈষম্য বাড়বে
এনবিআরকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে কর অব্যাহতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। সংস্থাটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে। ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে সংস্থাটি। এই তিন অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত এক দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াতে হলে এনবিআরকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা এনবিআরের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি কিনতে ২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। বিশেষ অব্যাহতির পরিমাণ ৬৫৫ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। কাঁচামাল ক্রয় বাবদ ৫০৯ কোটি ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে এই খাতে ছাড় দিয়ে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে এক হাজার ১৬০ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ছাড়ের গড় পরিমাণ ছিল ৬৭৩ কোটি টাকা। ছাড় বেড়েছে পোল্ট্রি খাতেও। এ সময়ে ২৮০ কোটি টাকা ছাড় পেয়েছে পোল্ট্রি খাত, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৬৩ কোটি টাকা। সিমেন্ট তৈরির উপাদান চুনাপাথর আমদানিতেও ২০৯ কোটি টাকা রাজস্ব ছাড় দিয়েছে এনবিআর।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রথম প্রান্তিকে কর অব্যাহতির পরিমাণ কমেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। যদিও কর অব্যাহতি আরও যৌক্তিক করতে হবে। কারণ এটা সম্পূর্ণভাবে কমানোর সুযোগ নেই। তবে সরকারের উচিত পদ্মা সেতু, রূপপুর প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পে অব্যাহতি না নেওয়া। এতে প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় কত হয়েছে তা নিরূপণ করতে সুবিধা হবে। অন্যদিকে এটি রাজস্ব আদায় রাড়াতেও ভূমিকা রাখবে।
এসএম/কেএসআর/এমএস