আলুর দামে আগুন, আমদানিতে সমাধান খুঁজছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:২৬ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২৩
আলুর আমদানি ছাড়া আর কোনো সমাধান দেখছে না সরকার/ফাইল ছবি

বছরের শুরু থেকে আলুর বাজার চড়া। গত দশ মাসে বেশিরভাগ সময় আলুর কেজি ছিল ৫০ টাকা বা তারও বেশি। অথচ আগের বছরগুলোতে একই আলুর দাম ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ কৃষিপণ্যটির দাম বাড়তে বাড়তে এখন ৭০ টাকায় উঠেছে। কোথাও কোথাও ৬৫ আবার বাজারে বড় দোকানে ৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। তবে আলুর এ অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় অস্বস্তিতে সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আলুর দাম বাড়াকে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ উল্লেখ করে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশও করছেন। ঠিক এমন সময়ই আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ‘আমদানিতে সমাধান’ খুঁজছে সরকার।

গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সরকার খুচরা বাজারে আলুর দাম নির্ধারণ করে কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। সেই আলু এখন বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে, অর্থাৎ ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। দাম নির্ধারণের প্রায় দেড় মাসেও তা বাজারে কার্যকর করতে পারেনি সরকার। বাধ্য হয়ে সোমবার (৩০ অক্টোবর) আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে সায় দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন: আলু আমদানি হলে দাম কমবে, মানুষ স্বস্তি পাবে: কৃষিমন্ত্রী

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজারে আলুর সরবরাহ বৃদ্ধি ও দাম স্থিতিশীল রাখতে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগ্রহী আমদানিকারকদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিনই অনুমোদনপত্র দেওয়া শুরু করার কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।

jagonews24

বাজার স্থিতিশীল রাখতে আলু আমদানির অনুমতি দিতে আরও মাসখানেক আগেই সুপারিশ করেছিল জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তখন সেই সুপারিশে কৃষি মন্ত্রণালয় সায় দেয়নি। এখন আবার এমন সময় আমদানির অনুমতি দেওয়া হলো যখন দেশের বাজারে কিছুদিনের মধ্যে শীতকালীন নতুন আলু উঠবে।

অন্যদিকে একই সময়ে প্রায় দেড় মাস আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও এখনো আমদানি শুরু হয়নি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনটি কৃষিপণ্যের দাম বেঁধে দেয়। সেগুলো হলো ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজ।

বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, প্রতিটি ফার্মের ডিম ১২ টাকা, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭ টাকা) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা। তবে সরকারের এ নির্দেশনার প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজ নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না বাজারে। এ অবস্থায় আলু আমদানি নিয়েও সংশয়ের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন: দু’তিন দিনের মধ্যে দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে আলু আমদানি

বাংলাদেশে আলু আমদানি হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে আলুর দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কম। দেশটির কমোডিটি অনলাইনের তথ্যমতে, বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি আলুর গড় দাম ২০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ২৬ টাকা। এ আলু আমদানি সম্ভব হলে খরচসহ ৩০ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে বাজারজাত করা সম্ভব হবে, যা বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে আলুর দামের প্রায় অর্ধেক।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, হিমাগার মালিকরা বাজারে পর্যাপ্ত আলু ছাড়ছেন না। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন। এমনকি হিমাগারে আলু গোপনে মজুত রেখে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। এ অবস্থায় আমদানি ছাড়া কোনো সমাধান দেখছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

jagonews24

তবে এসময়ে আলু আমদানির সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ মন্তব্য করে আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ফেরদৌস বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফেরদৌসী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আলু আমদানির সিদ্ধান্ত ‘মাথাব্যথার কারণে মাথাই কেটে ফেলার মতো’ হবে। এতে দেশে অবিক্রীত ২০ লাখ টন আলু পচে যাবে। ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতি হবে। বাড়তি আলু কোথায় যাবে?

তিনি বলেন, এখানে কিছু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট রয়েছে। সেটা চিহ্নিত হোক। সেজন্য সব ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা। সেটা তারা করতে পারছে না। ব্যর্থ হয়ে এখন আমদানি করতে চাচ্ছে। এটা অসৎ উদ্দেশ্য।

ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ আলু রপ্তানিকারক দেশ। দেশটিতে গত বছর চার কোটি ৯৭ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টন রপ্তানি হয়েছে। তবে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বে ষষ্ঠ। দেশে গত ৫০ বছরে আলু উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। এ বছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ টন, যেখানে স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদন হলেও বাজারে এ কৃষিপণ্যটির দাম বাড়ছে হু হু করে। অথচ পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন হওয়ায় অতীতে আলু আমদানির প্রয়োজন তো হয়ইনি, বরং উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানি করা গেছে।

আরও পড়ুন: সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে আলু আমদানির সুপারিশ

সরকারের কয়েকটি সংস্থার দাবি, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা। চাষিরা এ আলু বাজারে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৩ টাকায় বিক্রি করেছেন। পাইকারি পর্যায়ে আলুর দাম সব খরচ মিলিয়ে কোনোভাবেই ২৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, যা খুচরা পর্যায়ে এসে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার কথা।

গত জুলাই পর্যন্ত বিক্রির জন্য দেশের ৩৬৫টি হিমাগারে ২০ লাখ ৯২ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা ছিল। কৃষকের হাতের আলু শেষ হওয়ার পর গত জুন মাস থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আলুর দাম বাড়াতে শুরু করেন। এতে সরবরাহও ব্যাহত হতে থাকে। এর মধ্যে হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছেন। ফলে কৃত্রিম সংকটের দিকে যাচ্ছে বাজার।

jagonews24

সোমবার (৩০ অক্টোবর) সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দাম বেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে নিম্নআয়ের মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে। গত দুদিনে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

কোল্ড স্টোরেজে আলু থাকার পরও দাম এত বাড়বে কেন- মন্ত্রী নিজেই এমন প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা আলুর যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, তাতেও ব্যবসায়ীদের লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু সেই দামের ধারেকাছেও তারা থাকছে না। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা একটি সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা আলু বের করেন না, তারা আলু লুকিয়ে রাখেন।

আরও পড়ুন: এবার আলু আমদানি করবে সরকার

ব্যবসায়ীরা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, মৌসুমের শুরুতে তারা যে আলু সংগ্রহ করেন, সেগুলো প্রতি বছর মে মাসের পর হিমাগার থেকে বের করা হয়। এবার আলুর সংকট থাকায় এপ্রিল মাস থেকেই আলু বের করা শুরু হয়েছে। এজন্য হিমাগারে আলুর সংকট আছে। মজুত আলু ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। মজুত আলু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কৃষকদের কাছ থেকে চড়া দামে আলু কিনতে হয়েছে তাদের।

তারা বলছেন, এখন সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে গেলে কেজিতে ৮ থেকে ৯ টাকা লোকসান গুনতে হবে। তাই চাইলেও নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে পারছেন না তারা।

এনএইচ/এমকেআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।