প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক
# আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি প্রায় ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা
# বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা
বিশেষ সুবিধা আর ছাড় দেওয়ার পরেও কমছে না খেলাপি ঋণ। বিপরীতে ব্যাংক খাতের ‘প্রধান সমস্যা’ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। একবার কিছু কমে আসছে তো ফের বাড়ছে। এবার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে, খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ জুন প্রান্তিক শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের আট বাণিজ্যিক ব্যাংক বড় ধরনের প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি প্রায় ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর আগে মার্চ প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় অনেক বেশি। মার্চ শেষে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন>> ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা
নিয়মানুযায়ী সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, সেগুলোর গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে আলাদা হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) জমা রাখতে হয়। শেষপর্যন্ত কোনো ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হলে এতে ব্যাংক আর্থিকভাবে যেন ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান রাখা হয়। ঋণের মান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে, নিম্ন বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিনটি সরকারি ও বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংক রয়েছে। জুন প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সরকারি তিন ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ রাখায় এসব ব্যাংকের সার্বিক ঘাটতি ১০ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। আর সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকায়।
আরও পড়ুন>> ২ থেকে এক লাফে ৫ শতাংশ সুদ চায় বিশ্বব্যাংক
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের। আলোচিত প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৩১১ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৯৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। বেসরকারি অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫১৬ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৪৩৯ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৪১৯ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২০৪ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
আরও পড়ুন>> সব রেকর্ড ভেঙে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা
তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে জুনে খেলাপি ঋণ ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়ে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। খেলাপি কমাতে না পারলে ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে।
আরও পড়ুন>> ১৫ ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে কঠোর বার্তা গভর্নরের
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, করপোরেট গভর্নেন্স ও খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা নিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই, কার্যকর পদক্ষেপও নেই। খেলাপির যে চিত্র এসেছে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ, বড় হবে। করোনা পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়া হলো, অন্যান্য সময়ও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। মোট ঋণের কিছুটা পরিশোধ করলেই আর তিনি খেলাপি না, এমনটা বার বার করেও সুফল কতটুকু তা দেখতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ পরিশোধে বার বার সুযোগ দেওয়ার পরও কোনো সুফল আসেনি। যে রেগুলেশন আছে সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যিনি ঋণ বিতরণ করছেন তাকে এবং যিনি ঋণ নিচ্ছেন তাকেও একই চোখে দেখতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বিতরণও চলছে। এভাবে খেলাপি কমবে না। এভাবে ব্যাংক চলতে পারে না।
আরও পড়ুন>> কেনা দামের চেয়ে বাজারমূল্য কমলে প্রভিশন রাখার নির্দেশ
ইএআর/এমএএইচ/এমএস