অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবছে শ্যামপুর প্যাকিং হাউজ, হুমকিতে রপ্তানি
অডিও শুনুন
ইউরোপের দেশগুলোতে যে কোনো কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে গেলে পুরান ঢাকার শ্যামপুরে অবস্থিত সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ থেকে মোড়কজাতকরণ বাধ্যতামূলক। সরকারের একমাত্র এ প্যাকিং হাউজটি রপ্তানিকারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানটির ফাইটোস্যানিটারি সনদ (পিসি) না হলে পণ্য জাহাজীকরণ সম্ভব নয়। পণ্য প্যাকিংয়ে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতিতে হয়রানির শিকার হতে হয় রপ্তানিকারকদের। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপঢৌকন দিতে গিয়ে বাড়ছে রপ্তানিমূল্য। অনেক রপ্তানিকারক বিরক্ত হয়ে ইউরোপে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, শ্যামপুর প্যাকিং হাউজে সনদ নিতে পদে পদে ঘুস দিতে হয়। এ কারণে পণ্য মোড়কজাতকরণের খরচ এতটাই বেড়েছে যে রপ্তানিকারকরা অন্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে টিকতে পারছেন না ইউরোপের বাজারে। বাধ্য হয়ে সেখানে পণ্য রপ্তানি ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। গত কয়েক বছর যার প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক রপ্তানিতেও। নেতিবাচক ধারায় চলছে কৃষিপণ্য রপ্তানি।
দেশের রপ্তানিখাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্যাকিং হাউজ বেশ কয়েকবার সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে জাগো নিউজ। কথা বলেছে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী রপ্তানিকারকদের সঙ্গে। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিটি পণ্যের চালানে নির্ধারিত পরিমাণ ঘুস ছাড়াও বিভিন্ন সময় পণ্যের নেতিবাচক মানের অজুহাতে জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে। এমনকি পণ্যবাহী উড়োজাহাজের ফ্লাইটের আগ মুহূর্তেও পণ্য আটকিয়ে রেখে অবৈধ লেনদেনের ঘটনাও রয়েছে প্যাকিং হাউজে।
আরও পড়ুন>> ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ
পাশাপাশি কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের বাধ্য করে প্যাকিং হাউজের বিভিন্ন সামগ্রী কিনে নেওয়া, কর্মরত চুক্তিভিত্তিক বেশকিছু কর্মীর বেতন রপ্তানিকারক সংগঠন থেকে আদায় এবং রপ্তানিপণ্য উপঢৌকন হিসেবে হাতিয়ে নেওয়ার মতো অনিয়ম সেখানে নিয়মিত ঘটনা।
ওই প্যাকিং হাউজের দুই-নাম্বারির কারণে ইউরোপের বাজার ছেড়ে দিয়েছি। ইউরোপে রপ্তানি করতে গেলে সেখানকার সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। আর সেজন্য সেখানে প্রতি পদে পদে পয়সা দিতে হয়। পণ্য যা হোক সেখানে পয়সা দিলে সব ছাড় করতে পারবেন, না হলে নয়।
প্যাকিং হাউজ ঘিরে চলছে সরকারের অর্থ অপচয়ের মহোৎসবও। এটি চালুর পরে দুই দফা অধুনিকায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে শত শত কোটি টাকা। প্রথম দফায় ‘বাংলাদেশ ফাইটোস্যানেটারি শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় কেনা ৪৫ ধরনের ৭০টি যন্ত্রপাতির অধিকাংশের হদিস নেই। সামান্য কিছু যন্ত্র আছে, যেগুলো এখনো প্যাকেটবন্দি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে কয়েক বছর কেটে গেলেও এখনো খোলা হয়নি প্যাকেট। পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে অধিকাংশ যন্ত্র। এসব কিনতে ওই সময় ব্যয় দেখানো হয়েছিল ৬০ কোটি টাকার বেশি।
মোট ১৮৯ কোটি টাকার প্রথম প্রকল্পের আওতায় প্যাকিং হাউজে একটি কৃষিপণ্যের পরীক্ষাগার (ল্যাব) হওয়ার কথা ছিল। প্যাকিং হাউজের তিন তলায় এখন ওই ল্যাবের চার দেওয়াল ছাড়া কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপরও সেই অস্তিত্বহীন ল্যাবটি অধুনিকায়ন, আরও যন্ত্রপাতি কেনাসহ দশটি আলাদা ল্যাবরেটরি নির্মাণ ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চালুর জন্য নতুন করে ১৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শতভাগ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া ‘উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ নামে ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)।
আরও পড়ুন>> অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোয় ধীরগতি
২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ওই চলমান প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত দু’বছরে নতুন প্রকল্পটির অগ্রগতি আগের পরীক্ষাগারের মেঝে ও দেওয়ালের সাধারণ পলেস্তারা চটিয়ে নতুন করে ইপোক্সি রেজিনের পলেস্তারা দেওয়া পর্যন্ত। পাশাপাশি প্যাকিং হাউজের পুরো ভবনটি এয়ারকন্ডিশনে রূপান্তরের প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে একদফা পরিবর্তন হয়েছে প্রকল্প পরিচালকও। নতুন পরিচালক প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারবেন না বলে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, সম্ভাবনা রয়েছে ব্যয় বাড়ারও।
কর্মকর্তাদের এত বেশি বলা হচ্ছে, সতর্ক করা হচ্ছে, অনুশাসন দেওয়া হচ্ছে, তারপরেও কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা ওইভাবে অনেক সময় সামনে আসে না। আমাদের কর্মকর্তাদের ওখানে বেছে বেছে দেওয়া হয়, তারপরেও এগুলো হচ্ছে কি না আমি খোঁজ নেবো।
প্যাকিংয়ের ‘কুলিং হাউজ’ এখন ঘুমঘর!
সরেজমিনে প্যাকিং হাউজে গিয়ে দেখা যায়, ইউরোপের যে কোনো দেশে সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য নিয়মিত সালমোনেলাসহ যে কোনো ধরনের দূষণ, কীটনাশকের রেসিডিউ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ রয়েছে কি না, বিভিন্ন ধরনের এমআরএল পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু সেখানে ল্যাব না থাকায় এ কাজটি হচ্ছে না। ঠিক নেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চারটি কুলিং কক্ষের কোনোটিই। একটি সাময়িক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্য দুটি কুলিং হাউজ এখন বন্ধ। বাকি একটি কুলিং কক্ষের মধ্যে দেখা গেলো ‘আজব’ ঘটনা! সেখানে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, অর্থাৎ কর্মচারীরা সেটি তাদের আবাসন হিসেবে ব্যবহার করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এদের রান্নাও হচ্ছে তিনবেলা সেখানে। রয়েছে চুলা ও টুকটাক আসবাব।
তিনটি উচ্চমানের ফ্রিজার এখন নষ্ট। সেগুলো তালাবদ্ধ। এমনকি পণ্য বাছাই, শ্রেণীকরণ কিংবা মোড়াকজাতকরণের কক্ষগুলোর বেহাল দশা। কোনো কক্ষেই চলছে না এসি, নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। স্তূপ করে রাখা ময়লা।
পণ্য জীবাণুমুক্ত করতে সেখানে গরম পানিতে ধোয়ার প্রয়োজন হয়। সেই কক্ষেও আসে না গরম পানি। শুধু কিছু কক্ষে টেবিল আর কিছু ভাঙা ট্রলিই যেন প্যাকিং হাউজের সম্বল।
তিনতলা ভবনের নিচতলা ও দোতলায় সবজি এবং ফলমূলের মান যাচাই-বাছাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য আলাদা কক্ষ আছে। তবে এলাকাজুড়ে তিন-চারজন কর্মী ছাড়া কেউ নেই।
যন্ত্র আছ, তিনতলার দুই রুমে তালাবদ্ধ। ভেতরে সার্বক্ষণিক এসি চালিয়ে দেওয়া আছে। ওগুলো আবার সেটআপ হবে। তবে ৭০টি যন্ত্র কি না সেটা আমি জানি না। কী কী আছে সেটা জানা নেই।
ভবনের দ্বিতীয় তলায় একপাশে কর্মকর্তাদের জন্য বসার কক্ষগুলোও ফাঁকা। তিন তলার একপাশে রপ্তানিকারকদের প্রশিক্ষণের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল প্রশিক্ষণকক্ষ, সভাকক্ষ, বিদেশি আমদানিকারকদের জন্য বিলাসবহুল কক্ষ- কোথাও কেউ নেই। আরেক পাশে চলছে ল্যাব স্থাপনের জন্য মেঝের পলেস্তারার কাজ।
প্যাকিং হাউজ পরিচালনার জন্য কৃষি অধিদপ্তরের নিযুক্ত উপ-পরিচালক এস এম খালিদ সাইফুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, পণ্যবাহী উড়োজাহাজের ফ্লাইট রাতে হওয়ায় রপ্তানিকাকেরা সাধারণত বিকেলে আসেন। পণ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলে সন্ধ্যা থেকে রাতভর।
এরপর প্রতিবেদক পরের রোববার সন্ধ্যায় উপস্থিত হোন সেখানে। ওইদিন নিচতলায় ভূঁইয়া করপোরেশন নামে মাত্র একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের পণ্য প্যাকিং করতে দেখা যায়। ওই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ইউরোপে কিছু পেয়ারা ও তাল পাঠানোর জন্য প্যাকিং করছিলেন। সেটা নিচতলার মাত্র একটি কক্ষে। অন্যদিনের মতোই বাকি কক্ষগুলো ফাঁকা, তবে দোতলায় দুজন কর্মকর্তা দেখা যায়। সে সময় বাকি কর্মকর্তারা কোথায় এবং প্যাকিং কার্যক্রম এমন শ্লথ কেন জানতে চাইলে উপস্থিত অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সজীব মুখার্জী বলেন, এখন ইউরোপে পণ্য পাঠানোর সিজন (মৌসুম) নয়। সেজন্য কাজ কম। তাই সবাই এদিক-সেদিক রয়েছেন।
জনবল নয়জন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১২শ কর্মকর্তা
শ্যামপুর প্যাকিং হাউজে এখন মোট জনবল মাত্র নয়জন। এর মধ্যে পাঁচজন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা, দুজন সংযুক্ত কর্মকর্তা এবং দুজন বদলিতে সেখানে কাজ করছেন। তবে তাদের মধ্যে কেউ প্রশিক্ষিত নন।
যদিও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম প্রকল্পের টাকায় এ প্যাকিং হাউজ পরিচালনার জন্য দেশে এক হাজার ২৫০ জন এবং বিদেশে (ভারত-সিঙ্গাপুর) ৯০ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
তারা এখন কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে উপ-পরিচালক বলেন, তাদের কেউ খামারবাড়িতে (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর) রয়েছেন, কেউ বদলি হয়ে অন্যখানে চলে গেছেন। আসলে আমার ঠিক জানা নেই, কে বা কারা এখানকার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে আমরা যারা আছি, তাদের কেউ প্রশিক্ষিত না।
আরও পড়ুন>> বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে কমেছে রপ্তানি
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রশিক্ষিত ওই জনবলের একটি তালিকা রয়েছে কৃষি অধিদপ্তরে। প্রশিক্ষিতরা এখন দেশের বিভিন্ন বন্দরে সঙ্গনিরোধ ল্যাব পরিচালনা করছেন।
চলমান প্রকল্পে নতুন করে ল্যাব সংস্কার করে পরিচালনার জন্য আউটসোর্সিংয়ে অন্য ৫০ জন কর্মকর্তা চাওয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। পাশাপাশি জনপ্রশাসনে রয়েছে ১৩৩টি পদে জনবলের নতুন প্রস্তাব। এরাও নিয়োগ পেলে নতুন প্রকল্পে নতুন করে অংশ নেবে দেশ-বিদেশের নানা প্রশিক্ষণে। চলবে সরকারের অর্থবিলাস।
তালাবদ্ধ ঘর, হদিস নেই আগের প্রকল্পের যন্ত্রের
এ প্যাকিং হাউজের জন্য প্রথম ফাইটোস্যানেটারি প্রকল্পে ৭০টি দামি যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। তবে ওই প্রকল্প মেয়াদে ল্যাব পুরোপুরি না হওয়ার কারণে সেগুলো ব্যবহার হয়নি। এখন ওই যন্ত্রগুলো ভবনের তিনতলার দুটি কক্ষে তালাবদ্ধ রয়েছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। যদিও আদতে ওইসব কক্ষে কী রয়েছে সেটা কেউ জানেন না। প্রতিবেদককেও দেখানো হয়নি সেই ঘরের কোনো যন্ত্রাংশ। ঘরটি নাকি খোলা হয় না।
ওইসব যন্ত্র পুনর্ব্যবহার হওয়ার কথা রয়েছে চলমান প্রকল্পে। কিন্তু সেই প্রকল্পের পরিচালকই জানেন না কী যন্ত্র রয়েছে সেখানে। জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্পের পরিচালক শামিম আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যন্ত্র আছ, তিনতলার দুই রুমে তালাবদ্ধ। ভেতরে সার্বক্ষণিক এসি চালিয়ে দেওয়া আছে। ওগুলো আবার সেটআপ হবে। তবে ৭০টি যন্ত্র কি না সেটা আমি জানি না। কী কী আছে সেটা জানা নেই।’
একই প্রশ্নের জবাবে উপ-পরিচালক খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘ল্যাব যখন ভাঙছে সেগুলো স্টোররুমে রেখে দিয়েছে। ওগুলোর কিছু ব্যবহার হবে যেগুলো ফাংশনাল। যন্ত্রের একটি তালিকা রয়েছে, সম্ভবত। আমি জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমি ছয়মাস এখানে যোগ দিয়েছি। তখন আমাকে কেউ যন্ত্রগুলো বুঝিয়েও দেয়নি। এখানে স্টোরকিপারের পদ শূন্য। কেউ একজন ওই সময় বুঝে নিয়েছেন হয়তো। ফলে যন্ত্রগুলো নিয়ে আমার সঠিক ধারণা নেই। আর আমি সেগুলো ধরবো কেন? আমার কোনো এক্সপার্টিজ নেই।’
এদিকে এ যন্ত্রগুলো কেনা ‘বাংলাদেশ ফাইটোস্যানেটারি শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের তিনজন পরিচালকের একজন মারা গেছেন। বাকি দুজনের চাকরি শেষ বলে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি জাগো নিউজের সঙ্গে।
প্যাকিং হাউজের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যন্ত্রগুলো দিয়ে গেছে। ওভাবেই পড়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। যাচাই-বাছাইয়ের আগে বলার উপায় নেই মেশিনারিজগুলোর মধ্যে কোনোটা নষ্ট হয়েছে কি না। এছাড়া ওই সময় যেসব যন্ত্র কেনা হয়েছে, এখন তারচেয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্র এসেছে। ফলে নতুন ল্যাব অ্যাক্রিডিটেশনের জন্য ওইসব যন্ত্র কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটা একটি বড় প্রশ্ন।
এদিকে গত ছয় বছরে বিভিন্ন উদ্যোগের পরেও এখানে ল্যাব না হওয়ার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের। এখন বেসরকারি বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে, গুনতে হচ্ছে চড়া টাকা। সেন্ট্রাল প্যাক হাউজে পণ্য রেখে একটি ল্যাবে গিয়ে টেস্ট করে রিপোর্ট এনে তবেই তারা পণ্য রপ্তানি করতে পারে। সময় বেশি লাগায় পণ্যের মানের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। পণ্যভেদে হিট ওয়াটার ট্রিটমেন্টসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়। এসব প্রযুক্তির সবগুলোই ল্যাবটিতে থাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে নেই।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, এতে তারা বিশ্ববাজারে রপ্তানিতে বেশ পিছিয়ে পড়ছেন এবং দেশেও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
আড়াইশো টাকার সনদের জন্য ঘুস কমপক্ষে চার হাজার
সরকার শ্যামপুর প্যাকিং হাউজ থেকে পণ্য প্রক্রিয়াকরণের পরে সনদের জন্য সর্বসাকুল্যে ফি নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজিতে ২৫ পয়সা। অর্থাৎ, এক টনের একটি পণ্যের চালানে রপ্তানিকারককে চালান পরিশোধ করতে হবে ২৫০ টাকা। বেশি হলে খরচ বাড়বে, কমবে কম হলে। কিন্তু তিনজন রপ্তানিকারক জাগো নিউজকে জানান, তাদের প্রতিটি চালানে সর্বনিম্ন চার হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়। বেশি হলে দিতে হয় আরও বেশি। নতুবা ফাইটোস্যানিটারি সনদ (পিসি) আটকে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, ‘রপ্তানির জন্য পণ্য শ্যামপুরে আনুন তাহলে বুঝবেন কত লাগে। একটা শিপমেন্টে কম করে চার হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়। টাকা ছাড়া মাল (পণ্য) ইউরোপে যাবে না। পিসি আটকে যাবে। বড় শিপমেন্ট হলে আরও বেশি নেবে ওরা (প্যাকিং হাউজের কর্মকর্তারা)।’
তিনি বলেন, ‘ওই টাকা ছাড়া আরও অনেক খরচ আছে। সঙ্গনিরোধ সার্টিফিকেট প্রয়োজন হলে আলাদা টাকা লাগে। আর পণ্য নিয়ে এসে এখানে সব খরচ আমাদের বহন করতে হয়। টাকা ছাড়া মাল গাড়ি থেকে নড়ে না, ওঠেও না। আমাদের মাল না গেলে ওনাদের (কর্মকর্তাদের) কী? বাধ্য হয়ে আমাদের টাকা দিতে হয়।’
তবে এ বিষয়টি প্যাকিং হাউজ পরিচালনাকারী কর্মকর্তা খালিদ সাইফুল্লাহ অস্বীকার করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের কথা জানি না। আমি আসার পরে রপ্তানিকারকদের বলে দিয়েছি, টাকা চাইলে আমাকে অভিযোগ দিতে। প্রতিদিন আমি এখানে আছি, কই কোনো সমস্যা নেই তো এখানে। আমি শুনিনি এমন।’
যদিও এ ঘুসের টাকার মধ্যে প্রতিটি চালানে ১৫শ টাকা ভাগ পান এই উপ-পরিচালক বলেও অভিযোগ করেন ওই রপ্তানিকারক।
প্যাকিং হাউজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, কর্মচারীদের বেতন দেন রপ্তানিকারকরা
গত ফলের মৌসুমে ইউরোপে প্রচুর আম রপ্তানি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন শ্যামপুর প্যাকিং হাউজে। এরপর ওই সময় একদিনে ৫৮টি পর্যন্ত ফলের চালান বিদেশে গেছে।
তবে ওই সময় সারাদেশে বেড়ে যায় বিদ্যুতের লোডশেডিং। তখন প্যাকিং হাউজের বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থাকলেও সেটা ছিল অচল। এরপর রপ্তানিকারকদের জিম্মি করে কিনে নেওয়া হয় প্যাকিং হাউজের জেনারেটর ও কর্মকর্তাদের রুমের আইপিএস।
এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের লাইট-ফ্যান, পানির কল বা ঝাড়ু- যাই নষ্ট হোক, রপ্তানিকারকদের সেটি মেরামত করে বা কিনে দিতে হয়। কর্তৃপক্ষ সেটা করে না, রপ্তানির তাগিদে বাধ্য হয়ে করেন তারা।
এ প্যাকিং হাউজটির সঙ্গে সবজি-ফল ও তাজা পণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) একটি সমন্বয় কমিটি রয়েছে। যে কমিটির কাজ প্যাকিং হাউজে রপ্তানিকারকদের সুযোগ-সুবিধা দেখা। বিএফভিএপিইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোবাশ্বের রহমান জুয়েল ওই কমিটির আহ্বায়ক। ওই লোডশেডিংয়ে সেখানে আইপিএস কিনে দিয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘গত মৌসুমে আমি আইপিএস দিয়েছি।’
প্যাকিং হাউজের সুযোগ-সুবিধা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনবরত এ প্যাকিং হাউজ নিয়ে এক্সপোর্টারদের অভিযোগ আসে। সেখানে গরম, এসি চলে না। শ্রমিকের ঘামে পণ্য প্যাকিং হাইজেনিক হয় না। তারা তেমন কোনো সুবিধা দেয় না ‘
বিএফভিএপিইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, সেখানে চারজন পরিচ্ছন্নকর্মীর বেতনও দিতে হয় আমাদের সংগঠন থেকে। আবার বিভিন্ন এলাকায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের যেসব প্রতিনিধি সমন্বয়ের কাজ করছেন তাদের বেতনও দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। এসব অর্থ জোগান দিতে আমাদের সাব-কমিটি করতে হয়েছে। অর্থাৎ, দিনশেষে সব খরচ পড়ে রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে, যা রপ্তানি পণ্যের মূল্য বাড়ায়।
জুয়েল বলেন, আমরা একদিন আগেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এসব বলেছি। কিন্তু সমাধান হয়নি।
বাধ্য হয়ে ইউরোপের বাজার ছেড়েছেন বড় রপ্তানিকারক
এদেশ থেকে যারা বিদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানি করেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন উদ্যোক্তা ফেরদৌস বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফেরদৌসী বেগম। তিনি আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি। এ রপ্তানিকারক জানান, শ্যামপুর প্যাকিং হাউজের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
তিনি জাগো নিউজকে জানান, জাহাজীকরণের সময়ের কিছু আগে তার পণ্যের ট্রাক আটকিয়ে অবৈধ টাকা দাবি করা হয়েছিল। এমন পদে পদে জটিলতার শিকার হয়েছেন তিনি যখন ওই প্যাকিং হাউজে পণ্য প্যাকিং করতেন। অবৈধ লেনদেনের কারণে বাড়তি খরচের চাপ তার প্রতিষ্ঠানকে ইউরোপের বাজারে দুর্বল করেছে।
ফেরদৌসী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই প্যাকিং হাউজের দুই-নাম্বারির কারণে ইউরোপের বাজার ছেড়ে দিয়েছি। ইউরোপে রপ্তানি করতে গেলে সেখানকার সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। আর সেজন্য সেখানে প্রতি পদে পদে পয়সা দিতে হয়। পণ্য যা হোক সেখানে পয়সা দিলে সব ছাড় করতে পারবেন, না হলে নয়।’
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘পণ্যের শিপমেন্ট হয় ভোরে। সারারাত তারা টাকার জন্য যন্ত্রণা দেয় সেখানে কর্মরত আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। একদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, ভোররাতে আমার ম্যানেজার ফোনে বলেন ছয় হাজার টাকা ছাড়া ট্রাক ছাড়ছে না ওখানকার কর্তৃপক্ষ। ওই সময় টাকা জোগাড় করে দিতে হয়েছে আমার।’
তিনি বলেন, ‘আবার ওরা সঙ্গনিরোধ ছাড়পত্র পয়সা ছাড়া দেয় না। কেন সেখানে যাবো? অন্য দেশে পণ্য দেওয়া এরচেয়ে ভালো। কোনো ইউরোপের ক্রেতাকেও ওই প্যাকিং হাউজ দেখানোর মতো নয়। কিছুই নেই এখন। সব মেশিনপত্র গায়েব। এটা শুধু সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে।’
রাজস্ব নগণ্য, প্যাকিং হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টন
রপ্তানিকারকদের এত পকেট কাটছে যে প্রতিষ্ঠান, সেখান থেকে সরকারের প্রাপ্তি নেই। রপ্তানিকারকদের বিমুখতায় বছরে প্যাকিং হাউজ থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হচ্ছে মাত্র ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা, যা ওই প্রতিষ্ঠানের বছরের বিদ্যুৎ বিলের সমান।
অন্যদিকে দিন যত যাচ্ছে সবজি-ফল প্যাকিংয়ের পরিমাণও কমছে। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এ হাউজ থেকে রপ্তানি হয়েছে পাঁচ হাজার ১১২ টন কৃষিপণ্য (ফল ও সবজি), যা পরের বছর ২০২১-২২ এ কমে চার হাজার ৫৬৯ টনে আসে। আর শেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাড়ে ৪ হাজারের কাছাকাছি আটকে রয়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি: ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস কৃষি মন্ত্রণালয়ের
শ্যামপুর প্যাকিং হাউজের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের এত বেশি বলা হচ্ছে, সতর্ক করা হচ্ছে, অনুশাসন দেওয়া হচ্ছে, তারপরেও কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা ওইভাবে অনেক সময় সামনে আসে না। আমাদের কর্মকর্তাদের ওখানে বেছে বেছে দেওয়া হয়, তারপরেও এগুলো হচ্ছে কি না আমি খোঁজ নেবো।’
এসময় কৃষিসচিব মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘কুলিং সেন্টার ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে। পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে পরিবেশটা আগের থেকে ভালো হয়েছে, অর্থাৎ আগে আরও খারাপ ছিল।’
আগের প্রকল্পের যন্ত্রাংশ ও জনবলের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নতুন ল্যাব চালু হলে আগের যন্ত্রগুলো ব্যবহার হবে। আর ওই প্রকল্পে কারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের একটি ডাটাবেজ রয়েছে, তারা এখন অন্য সঙ্গনিরোধ ল্যাবে বদলি হয়ে কর্মরত। প্রশিক্ষণ বৃথা যাবে না। তারা এখনো কাজ করছে।’
সনদের জন্য বাড়তি অর্থ আদায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক। আমরা এটি খোঁজ নেবো। কেউ আইনের আওতার বাইরে থাকবে না। এ নিয়ে এখন থেকেই কাজ করবো। রপ্তানিকারকদেরও আহ্বান জানাচ্ছি তথ্য দিতে।’
তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কারও নামে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এনএইচ/এএসএ/জেআইএম