রপ্তানিকারকদের আশা
তৃতীয় টার্মিনাল সুবাতাস আনবে রপ্তানি বাণিজ্যে
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই রপ্তানির একটি বড় অংশ হয় বিমানবন্দর দিয়ে। সমুদ্রপথের তুলনায় আকাশপথে রপ্তানি ব্যয়বহুল হলেও লিড টাইম মোকাবিলায় আকাশপথে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠাতে হয় অনেক সময়। তবে এতে ঝক্কি-ঝামেলাও পোহাতে হয় অনেক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু হলে তাদের ভোগান্তি লাঘব হবে অনেকাংশে। থার্ড টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে রপ্তানিতে বইতে পারে সুবাতাস। বিশেষ করে প্রপার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এবং তদারকি সম্ভব হলে সুফল মিলবে। এছাড়া চালু করার পর ময়লা ও মশার উপদ্রপ যেন না হয়, নজর দিতে হবে সেদিকেও।
তারা আরও বলছেন, সেবার মান বৃদ্ধির জন্য তারা বিমানকে দীর্ঘদিন ধরেই অনুরোধ করেছেন। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং সেবার মান বৃদ্ধির কথা বলছেন তারা। এ সমস্যার কারণে অনেক সময় বায়ার দেশে আসে না। এবার তাদের ভোগান্তির পালা শেষ হচ্ছে।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভিয়েশন খাতের চিত্র পাল্টে দেবে শাহজালাল বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনাল। উন্নত দেশের মতো সব পয়েন্টে থাকবে অটোমেশন সুবিধা। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর আস্থাও বাড়বে। সরাসরি প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানিতে। অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে, উপকৃত হবে দেশ।
আরও পড়ুন: শাহজালালে থার্ড টার্মিনাল গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কাজ পাচ্ছে জাপান
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা থার্ড টার্মিনাল পরিচালনায় থাকবে জাপানিজ কোম্পানি। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর আস্থা বাড়ায় ট্রানজিট হিসেবেও এর ব্যবহারও বাড়বে। বিমানবন্দরটিতে যে দুটি টার্মিনাল আছে, তার যাত্রী ধারণক্ষমতা বছরে প্রায় ৭০ লাখ। তৃতীয় টার্মিনাল হলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান জানান, থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পাচ্ছে জাপান। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে তারা। তাদের কাজ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। তবে কাজের জন্য কী ধরনের শর্ত থাকবে তা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে নির্ধারণ হবে।
জাইকার অর্থায়নে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনাল। এর আয়তন প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। ২০২৪ সালের শেষে এ টার্মিনাল ব্যবহারের সুবিধা পাবেন যাত্রীরাও। টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য থাকছে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, ৬৪টি ডিপার্চার ও ৬৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ডেস্ক, ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি স্ক্যানিং মেশিন ও ১১টি বডি স্ক্যানার। চেকিং থেকে শুরু করে যাত্রীদের ব্যাগ সরাসরি স্ক্যান হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছে যাবে উড়োজাহাজে।
আরও পড়ুন: অক্টোবরেই থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন: বিমান প্রতিমন্ত্রী
রপ্তানিকারকরা জাগো নিউজকে জানান, বিমানবন্দরে মশার কামড় আর অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরেই এর সমাধান দাবি করেছি। বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু অব্যবস্থাজনিত সমস্যার কারণে পোশাক শিল্পের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এরমধ্যে বড় সমস্যা কার্গো ভিলেজে পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেক্টর স্ক্যানার) মেশিনের স্বল্পতা। আবার বিমানবন্দর থেকে পণ্য নামানোর পর সেগুলো খোলা আকাশের নিচে রাখা, ক্যানোপিতে আমদানি করা মাল বিশৃঙ্খলভাবে রাখা।
তাদের মতে, পণ্য নামানোর পর তার কোনো মার্কিং না থাকা, ডকুমেন্ট অনুযায়ী মালামাল খুঁজে না পাওয়াও বড় সমস্যা।
বিজিএমইএ’র এক পরিচালক এ নিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। সেজন্য কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। ইডিএস মেশিনের সংখ্যা ও কার্গো হ্যান্ডলিং সেবা নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল। কার্গো হ্যান্ডলিং সেবার মান বৃদ্ধিতে বিমান কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা উন্নত নয়। থার্ড টার্মিনালে কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এটি তদারক করতে হবে।
আরও পড়ুন: থার্ড টার্মিনাল চালু হলে শাহজালালে লাগেজ হয়রানি বন্ধ হবে
এ বিষয়ে কথা হয় বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের ফলে দেশের ইমেজ বিল্ডআপ হবে। আমাদের এখানে বায়াররা অনেক সময় বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনার কারণে আসতে আনইজি ফিল (অস্বস্তি বোধ) করেন। তারা সংশয় বোধ করেন এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এ পরিবেশে দাঁড়িয়ে থাকা, মশার কামড়...। আবার লাগেজ আসতে দেরি হওয়া, সঠিক স্থানে বসার ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক সময় অস্বস্তি বোধ করেন বায়ার। যখন আধুনিক ব্যবস্থা চালু হবে, আধুনিক উপায়ে জিনিসগুলো হ্যান্ডেল করা হবে তখন আমাদের দেশে বায়ার আসতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এর সঙ্গে সরাসরি রপ্তানি জড়িত থাকবে। কারণ বায়ার আসা না আসার সঙ্গে রপ্তানি জড়িত।
পোশাক শিল্পোদ্যোক্তা ও ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, থার্ড টার্মিনাল আধুনিক হবে। কার্গো হ্যান্ডলিং বিদেশিদের দেওয়া হবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাবে আমরা যে পণ্য আনি বা এয়ারে পাঠাই, সেগুলো আরও অনেক বেশি ইফিসিয়েন্টলি হ্যান্ডেল করা হবে। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে। তবে আমরা মনে করি থার্ড টার্মিনাল চালু হওয়া এবং হ্যান্ডলিং প্রপারলি শুরু করলেই হবে না, এর তদারকিও করতে হবে। চালু করার পর ময়লা করে ফেলা, মশা আসা ইত্যাদি বা আগের মতো যেন না হয়। হ্যান্ডলিং যদি ঠিকমতো হয়, নতুন নতুন এয়ারপ্লেন যদি আসে, তাহলে আমাদের জন্য অনেক বেশি উপকার হবে। প্রপার হ্যান্ডলিং এবং নতুন নতুন এয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একটা বায়ার চিন্তা করে বাংলাদেশে যাবো না, তুমি ব্যাংককে আসো। আবার আমাদের অনেকেই ব্যাংককে যেতে পারে না। এতে অর্ডারে সমস্যা হয়। ভালো ব্যবস্থাপনা হলে বায়ার সরাসরি ঢাকায় চলে আসবে।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, থার্ড টার্মিনালের হ্যান্ডলিং ও নতুন উড়োজাহাজ চালু হলে অনেক উপকৃত হবে দেশ। আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে। পরিধি বাড়বে দেশের অর্থনীতির।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. ফরাস উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, থার্ড টার্মিনালের ম্যানেজমেন্ট কেমন হবে দেখতে হবে। এটা সম্ভবত জাপানিদের দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট হবে। তবে প্রথমেই রিফিউলিং চার্জ বেশি বেশি রাখা যাবে না। কারণ লাভের জন্য অনেক সময় আছে। ন্যায়সঙ্গতভাবে রিফিউলিং চার্জ করতে হবে। ম্যানেজমেন্ট যদি ভালো হয়, রপ্তানিকারকরা উপকৃত হবে। আরও বেশি উপকৃত হবে কটেজ-মাইক্রোসহ সব ইন্ডাস্ট্রি। শুধু আমদানি-রপ্তানিই সহজ হবে না, দেশের অর্থনীতির জন্যও খুবই উপকার হবে।
ইএআর/এমএইচআর/এএসএম