দু’তিন দিনের মধ্যে দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে আলু আমদানি

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২১ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ফাইল ছবি

অডিও শুনুন

# দেশের ৩৬৫ হিমাগারে প্রায় ২১ লাখ টন আলু রয়েছে
# একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বাড়াচ্ছে
# সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা
# চড়া দরে কেনা আলু সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে, দাবি ব্যবসায়ীদের

সরকার আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। তারপরও বাজারে অস্থিরতা কাটেনি, নির্ধারিত দামে পণ্যটি কিনতে পারছে না সাধারণ মানুষ। যে কারণে ডিমের পরে এবার আলু আমদানির চূড়ান্ত চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হলে আলু আমদানির ঘোষণা আসতে পারে।

‘দুই-তিন দিনের মধ্যে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে আমদানির করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিব এখন বিদেশে। গতকাল রাতেও (রোববার) মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা আরও দেখছি, আমদানির সিদ্ধান্ত নেবো।’-ভোক্তার মহাপরিচালক

গত সপ্তাহে দেশের সর্বোচ্চ আলু উৎপাদনকারী জেলা মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর এবং নীলফামারীতে অবস্থিত বিভিন্ন আলুর হিমাগার পরিদর্শনের পাশাপাশি হিমাগার মালিক সমিতির সদস্য এবং পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সেখানে তিনি আলু আমদানির ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আলু আমদানির সুপারিশ করার কথা ভাবছে ভোক্তা অধিদপ্তর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দেখছি, দু-তিন দিনের মধ্যে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে আমদানি করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিব এখন বিদেশে। গতকাল রাতেও (রোববার) মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা আরও দেখছি, আমদানির সিদ্ধান্ত নেবো।

আরও পড়ুন>> সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে আলু আমদানির সুপারিশ: ভোক্তার ডিজি

গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাজারে বাড়তে থাকা দামের লাগাম টানতে আলুসহ পেঁয়াজ ও ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। এর প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও খুচরা বাজারে সে দাম কার্যকর হয়নি। ওই সময় খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ও হিমাগার পর্যায়ে দাম নির্ধারণ না হওয়ার কারণে খুচরায় দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে অজুহাত দেখান। এরপর পাইকারি ও হিমাগার থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশনাও দেওয়া হয়। তাতেও দাম কমেনি। সে সময় ‘বিক্ষুব্ধ’ হয়ে কয়েকদিন হিমাগার থেকে আলু বিক্রিও বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে, বেঁধে দেওয়া অন্য দুটি পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি হয় শুরু থেকেই। তবে কখনো ডিম সেভাবে আমদানি হয়নি এর আগে। করোনার সময় একদফা অনুমতি দেওয়া হলেও সেটা পরে প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এবারই প্রথম ঘটা করে ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ভারত থেকে ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভারত থেকে আলু আমদানির পথে হাঁটতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে আলুর দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কম। ভারতের কমোডিটি অনলাইনের তথ্যে, বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি আলুর গড় দাম ১৪ দশমিক ৯৭ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজি ২০ টাকারও কম (১৯ টাকা ৮৫ পয়সা), যা পরিবহন খরচসহ ২৫ টাকার মধ্যে বাজারজাত করা সম্ভব। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে আলুর দামের অর্ধেক।

‘এখানে কিছু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট রয়েছে। সেটা চিহ্নিত হোক। সেজন্য সব ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা। সেটা তারা করতে পারছে না। ব্যর্থ হয়ে এখন আমদানি করতে চাচ্ছে। এটা অসৎ উদ্দেশ্য।’-আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি

এদিকে ভারত বিশ্বের শীর্ষ দ্বিতীয় আলু রপ্তানিকারক দেশ। এ দেশে গত বছর ৪ কোটি ৯৭ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যারমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টন আলু রপ্তানি হয়েছে। তবে, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। গত ৫০ বছরে আলু উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। এবছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ টন, যেখানে স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২০ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। আর বাড়তি উৎপাদনের কারণে এর আগে কখনো আলু আমদানির প্রয়োজন হয়নি। বরং কিছু আলু রপ্তানি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: আলু আমদানির অনুমতি প্রদান বন্ধের দাবি

আলু আমদানির সিদ্ধান্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিকর হবে মন্তব্য করে আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ফেরদৌস বায়োটেকের এমডি ফেরদৌসী বেগম বলেন, আলু আমদানির সিদ্ধান্ত ‘মাথাব্যথার কারণে মাথাই কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত’ হবে। এতে দেশে এখনো অবিক্রীত ২০ লাখ টন আলু পচে যাবে। ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতি হবে। বাড়তি আলু কোথায় যাবে?

আলু থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণে কেন আসছে না এমন প্রশ্নের জবাবে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখানে কিছু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট রয়েছে। সেটা চিহ্নিত হোক। সেজন্য সব ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা। সেটা তারা করতে পারছে না। ব্যর্থ হয়ে এখন আমদানি করতে চাচ্ছে। এটা অসৎ উদ্দেশ্য।’

সরকারের কয়েকটি সংস্থা দাবি করছে— চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। চাষিরা এ আলু বাজারে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৩ টাকার মধ্যে বিক্রি করেছেন। পাইকারি পর্যায়ে আলুর দাম সব খরচ মিলে কোনোভাবে ২৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, যা খুচরায় এসে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার কথা। এখনো দেশের ৩৬৫টি হিমাগারে ২০ লাখ ৯২ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা রয়েছে। কৃষকের হাতের আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এ সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বাড়াচ্ছেন। এর মধ্যে হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছেন। ফলে কৃত্রিম সংকটের দিকে যাচ্ছে এ বাজার।

আরও পড়ুন>> সাড়ে ৬ হাজার কেজি আলু জব্দ করে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে তারা যে আলু রাখেন, সেগুলো প্রতি বছর মে মাসের পর হিমাগার থেকে বের করেন। এবার আলুর সংকট থাকায় এপ্রিল মাস থেকেই আলু বের করা শুরু হয়েছে। এজন্য হিমাগারে আলুর সংকট আছে। মজুত রাখা আলু ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। মজুত করা আলু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কৃষকদের কাছ থেকে চড়া দরে আলু কিনে রেখেছেন। এখন সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করতে গেলে কেজিতে ৮ থেকে ৯ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে। তাই বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করতে পারছেন না।

এনএইচ/এমএএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।