বীজ আলুর জন্য হাহাকার, এখনই দাম ৪০ শতাংশ বেশি
দেশের বাজারে এবার আলুর দাম প্রথম থেকেই মোটামুটি ঊর্ধ্বমুখী। বেশি দাম পাওয়ায় বীজ আলু সংরক্ষণ না করে বিক্রি করে দিয়েছেন অধিকাংশ চাষি। আবার আলুর ভালো দাম পাওয়ায় আবাদেও আগ্রহ বেড়েছে অনেকের। আগামী মাস থেকে বপন করা হবে আলুর বীজ। অথচ এক মাস আগেই বীজ আলুর দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। চাষিরা দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত বীজ পাচ্ছেন না। সরকারের বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনও (বিএডিসি) চাহিদা অনুযায়ী বীজ পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বীজ আলুর সংকট দেখা দিচ্ছে এখনই। গত বছর যে সাদা আলু (গ্র্যানোলা) ও লাল (কার্ডিনাল) আলু বীজ ৪৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে এবছর সেই আলু বীজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকার ওপরে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে আগাম চাষ হওয়া দেশি ছোট গোল আলু (পাকড়ি) বীজের দাম উঠেছে ৮০ টাকায়। তারপরেও চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের বীজ পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় কৃষক। বিএডিসির অনুমোদিত ডিলারের কাছে ধরনা শুরু করেছেন অধিকাংশ চাষি। ঘুরছেন বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির ডিলারদের কাছেও। বীজ সংকটে এবার আলু চাষ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। রোপণ শুরুর আগেই বীজের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
আরও পড়ুন>> কারসাজিতে আটকা আলুর দাম
এদিকে আলু বীজ সংকটের কথা বলছে বিএডিসিও। বিএডিসির আলু বীজ বিভাগের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (সিডিপি ক্রপস) মো. মুজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এবার বীজের সংকট রয়েছে। বাজারে আলুর দাম ভালো থাকায় আলু বিক্রি করে দিয়েছেন অধিকাংশ চাষি। এখন আলুবীজের জন্য বিএডিসি বা বেসরকারি কোম্পানির আশায় রয়েছেন তারা।
এখনো আলু বীজের দাম চূড়ান্ত করিনি, দুই সপ্তাহের মধ্যে করবো। কৃষক ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মজুত আলুর তথ্য নিচ্ছি। আমাদেরও সংকট রয়েছে। তারপরেও গত বছরের মতো ৩৬ হাজার টন বীজ দেবো। তবে, দাম বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, আমরা এখনো বীজের দাম চূড়ান্ত করিনি, দুই সপ্তাহের মধ্যে করবো। কৃষক ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মজুত আলুর তথ্য নিচ্ছি। আমাদেরও সংকট রয়েছে। তারপরেও গত বছরের মতো ৩৬ হাজার টন বীজ দেবো। তবে, দাম বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন>> হিমাগার-মজুতদারদের কারসাজিতে ৩ গুণ আলুর দাম
বগুড়া শেরপুর এলাকার কৃষক আতাউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, অন্য বছর নিজেরাই হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ করতাম। কিন্তু এবার টাকার প্রয়োজনে বাজারে ভালো দাম থাকায় রাখা সম্ভব হয়নি। এখন ছোটাছুটি করেও বীজ মিলছে না। ডিলারের কাছে বীজের কোনো খোঁজ নেই। কোম্পানির (বেসরকারি কোম্পানি) আলুর বীজের চড়া দাম। তারপরেও ডিলাররা বলছেন— দাম আরও বাড়বে। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গুডুম্বা গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, এবার ভরা মৌসুমে আলু বীজের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা যাচ্ছে না। কেউ বীজ রাখেননি। বাধ্য হয়ে অনেকে আলু চাষ করতে পারবেন না। সরিষা চাষ করতে হবে।
আরও পড়ুন>> হিমাগারের আলু বাজারে আসতেই কেজিতে বাড়ে ১০ টাকা
আক্কেলপুরের ভরসা বীজ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী খাদেমুল রহমান বলেন, বিএডিসির কাছে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ অর্ধেকও পাওয়া যাবে না। কোম্পানিও (বেসরকারি কোম্পানি) বীজ দিতে চাচ্ছে না। মাত্র তিন টন বীজ পেয়েছি এ পর্যন্ত। যেখানে প্রয়োজন ১৫ থেকে ২০ টন। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কমের কারণে কৃষকদের ফেরত দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেসরকারি কোম্পানি ব্র্যাক, সুপ্রিম সিড ও স্কয়ারের বীজ ৭০ টাকার ওপরে, যা গত বছর ৫০ টাকার নিচে ছিল। এ হিসেবে একজন কৃষকের শুধু বীজের জন্য প্রতি বিঘায় খরচ বাড়ছে তিন হাজার ২০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ১৬০ কেজি আলুর বীজ প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন>> আলুর সংকট নেই, তবুও লাফিয়ে বাড়ছে দাম
বগুড়া সদর উপজেলার টিএমএসএস কোল্ড স্টোরেজে বীজ কিনতে এসেছিলেন আলু চাষি হেলাল উদ্দিন। তিনি জানান, ঘরে বীজ নেই, ডিলারের কাছে বীজ নেই, ব্যবসায়ীদের বীজে কোনো ভরসা নেই। মানসম্পন্ন বীজ কোথাও মিলছে না। হিমাগারের বীজের দামও এক লাফে অনেক বেড়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিঘাপ্রতি এত খরচ বাড়লে লোকসানের শঙ্কাও বেশি হবে।
জানতে চাইলে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বিএডিসিসহ বেসরকারি কোম্পানি থেকে বীজ মিলছে চাহিদার চেয়ে অনেক কম। চাহিদার অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ বীজ কৃষকের ঘরেই থাকার কথা। কিন্তু তাদের কাছে নেই। বাজারে আলুর ভালো দাম থাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। এজন্যই বীজ সংকট তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন>> যে গ্রামের আয়ের উৎস আলুর চিপস
তিনি বলেন, বগুড়া জেলায় ৫৮ হাজার হেক্টরে আলু চাষ হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। গত বছর হয়েছে ৫২ হাজার হেক্টরে। এবছর আলুর দাম ভালো ছিল, তাই ধারণা করেছিলাম উৎপাদন আবারও বাড়বে। কিন্তু বীজ সংকটে আবাদ কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক চাষি সরিষা চাষ করবেন।
বিএডিসিসহ বেসরকারি কোম্পানি থেকে বীজ মিলছে চাহিদার চেয়ে অনেক কম। চাহিদার অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ বীজ কৃষকের ঘরেই থাকার কথা। কিন্তু তাদের কাছে নেই। বাজারে আলুর ভালো দাম থাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। এজন্যই বীজ সংকট তৈরি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ মৌসুমে বগুড়ায় ৯৩ হাজার টন বীজ আলু প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ বীজের এ চাহিদা বিএডিসির কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু বিএডিসি ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রির জন্য সর্বোচ্চ এক হাজার এবং প্রদর্শনী খামার ও কৃষক পর্যায়ে বিক্রির জন্য আরও সর্বোচ্চ ৫০০ টন বীজ বরাদ্দ দিতে পারে, যা এখনো চূড়ান্ত নয়। সেটা হলেও অবশিষ্ট ৯১ হাজার মেট্রিক টন বীজ সংগ্রহ করতে হবে কৃষকদের নিজ উদ্যোগে। বগুড়া থেকে অন্য জেলায় বীজের সংকট আরও বেশি। কারণ অন্যতম উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে বগুড়া জেলায় সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তথ্য বলছে, দেশে বীজের মোট চাহিদার মধ্যে আলুবীজের চাহিদা অর্ধেক। দেশে মোট আলুবীজের চাহিদা প্রায় ৮ লাখ টন। এর মধ্যে বিএডিসি ৩৬ হাজার টন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সর্বোচ্চ ৫০ টন, বেসরকারি কোম্পানিগুলো এক লাখ টন বীজ সরবরাহ করে।
বাকি তিন-চতুর্থাংশের বেশি বীজ কৃষকরাই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। বাকিটা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো জোগান দেয়। কৃষকরা এসব বীজ কিনে বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে রাখছেন এবং আবাদ করছেন।
চলতি মৌসুমে আলুবীজ সংকটের বিষয়ে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এনএইচ/এমএএইচ/এএসএ/জিকেএস