জাতীয় শুল্ক নীতি-২০২৩
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সামঞ্জস্যে আমদানি শুল্ক-কর
পণ্যের মূল্যবৈষম্য কমানো, রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ, দেশীয় শিল্পের বিকাশে প্রথমবারের মতো জাতীয় শুল্ক নীতি প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার। গত ১০ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় শুল্ক নীতিমালার গেজেট প্রকাশ করে। পণ্য আমদানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক, কাউন্টারভেইলিং শুল্ক এবং সেইফগার্ড শুল্ক আরোপের বিধান রেখে জাতীয় শুল্ক নীতি-২০২৩ প্রণয়ন করলো সরকার।
একটি ডাম্পিং মূল্যে পণ্য আনা হলে, অর্থাৎ উৎপাদন খরচ বা অভ্যন্তরীণ মূল্যের চেয়ে কম দামে রপ্তানির জন্য বিক্রি করা হলে একটি অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। একটি কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে যদি একটি দেশ তার রপ্তানিতে ভর্তুকি দেয়।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটির নির্ধারিত হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমদানি শুল্ক ও কর নির্ধারণ করতে হবে।
আরও পড়ুন> দেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে হচ্ছে ‘ট্যারিফ পলিসি’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিমালাটি বাস্তবায়ন হলে বাণিজ্য উদারীকরণ ও শুল্ক কাঠামো যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগে উৎসাহিতকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সামঞ্জস্যপূর্ণ পণ্যের শুল্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য শুল্ক-হার সমান হওয়া উচিত। আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে আরোপিত শুল্ককে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপ্রবাহের নিয়ামক হিসেবে গণ্য করতে হবে। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা নিরসনে সম্পূরক শুল্ক ও আমদানি শুল্কের হার যৌক্তিক করতে হবে।
তবে জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে রেগুলেটরি ডিউটি, মিক্সড ডিউটি ও সিজনাল ডিউটি আরোপের অনুমতি দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়। ভোক্তার কল্যাণে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত শুল্ক ধাপে ধাপে যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করতে হবে। ব্যবহারভিত্তিক শুল্ক রেয়াত পরিহার করতে হবে। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) কেবল জরুরি পরিস্থিতিতে আরোপ করতে হবে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এবং মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) ‘বাণিজ্য নিরপেক্ষ কর’ এ পরিণত করতে হবে। আমদানি পর্যায়ে মোট শুল্ক-করের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে হবে। ন্যূনতম আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে শুল্কহার গণনার পদ্ধতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করতে হবে।
আরও পড়ুন> বিদেশে বাংলাদেশি পণ্যের ব্র্যান্ড করার এখনই উপযুক্ত সময়
নীতিমালায় আরও বলা হয়, সরাসরি ও রপ্তানির জন্য বিবেচিত পণ্যের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ হতে হবে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকরা যারা স্থানীয় ও রপ্তানি বাজারকে লক্ষ্য করে পণ্য উৎপাদনের জন্য আমদানি করেন, তারাও বন্ড সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন, তবে আমদানি করা কাঁচামালের ৭০ শতাংশ রপ্তানির জন্য ব্যবহার করতে হবে। এজাতীয় শিল্প আমদানিকারকদের নতুন শুল্কনীতি অনুসারে শুল্ক প্রত্যাহার সুবিধাও উপভোগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়।
নতুন নীতিমালাটি উদীয়মান শিল্পের জন্য বিশেষ সুরক্ষা সহায়তা প্রদান করবে, যাতে স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাতে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগীদের সঙ্গে টিকতে সক্ষমতা অর্জন করে।
জাতীয় শুল্ক নীতি-২০২৩ প্রণয়নের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ সবসময় একতরফা শুল্ক আরোপ করেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর একই প্রথা বজায় রাখা কঠিন হবে। তাই নতুন আইনের ফলে শুল্ক যৌক্তিকীকরণ সম্ভব হবে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্ধারিত মান বজায় রাখবে।
নতুন নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, এটি যুগোপযোগী একটি উদ্যোগ। এলডিসির চ্যালেঞ্জ, বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিত বিধিবদ্ধ নিয়ম পালনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত শুল্ক-হার বাউন্ডরেট শুল্কের মধ্যে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্ত কাগজে সীমাবদ্ধ রাখলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রতি বছরই বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এটির কাঙ্ক্ষিত হার বাস্তবায়নও জরুরি।
জাতীয় শুল্ক নীতি-২০২৩ বাস্তবায়নে বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মনিটরিং ও রিভিউ কমিটি গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে নীতিমালায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থবিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ৯ জন সচিব, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস পলিসি সদস্য, এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফেডারেশন অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি থাকছে এতে। চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এ কমিটির সদস্য। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান কমিটির সদস্য সচিব। রিভিউ অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, শুল্ক নীতি পর্যালোচনার জন্য বছরে দুটি বোর্ড সভা করবে।
সর্বোপরি নীতিমালায় বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়ন হলে অ্যান্টি-এক্সপোর্ট বায়াস হ্রাসের মাধ্যমে রপ্তানি সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, ট্যারিফ কাঠামো যৌক্তিকীকরণ, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। পাশাপাশি অর্থনীতির ওপর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
এসএম/এসএনআর/এএসএম