জবাবদিহি থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা
গত বছর দেউলিয়া হয় শ্রীলঙ্কা। তবে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এক বছরেই। বিশ্বমন্দা আর করোনা মহামারির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি সবার আগে ভেঙে পড়ে। রিজার্ভ তলানিতে ঠেকে। জ্বালানি সংকট চরমে। মন্ত্রীরা রাস্তায় মার খান। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
বর্ধিত মূল্যস্ফীতি শ্রীলঙ্কায় সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ শিল্পোৎপাদনের সব খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। কয়েকগুণ টাকা নিয়েও মেলেনি খাদ্য এবং জ্বালানি। ফিলিং স্টেশনগুলোয় লম্বা লাইন গোটা বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তোলে।
মাত্র এক বছর। মূল্যস্ফীতি ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে দেশটিতে। অথচ স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেও লাগামহীন বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা রেখে রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়, তার ধারে-কাছেও থাকছে না বাংলাদেশ। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ বেড়েছে দেশের মূল্যস্ফীতি। অতিমূল্যস্ফীতির কারণেই বিপর্যস্ত বাংলাদেশের জনজীবন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।
আরও পড়ুন>> শ্রীলঙ্কায় ১০ মাসে মূল্যস্ফীতি কমলো ১০ গুণ, জনগণের স্বস্তি
ভেঙে পড়া শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি কমছে অথচ বাংলাদেশে বাড়ছে! কারণ ও প্রতিকার নিয়ে মতামত নেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশের।
শ্রীলঙ্কা নিয়ে মতামত জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র কাঠামো শক্তিশালী ছিল। দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি রাষ্ট্র যেখানে শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এ অঞ্চলের যে কোনো রাষ্ট্র থেকে এগিয়ে। দুর্নীতি, করোনা আর যুদ্ধ পরিস্থিতি দেশটিকে দেউলিয়ার কাছে নিয়ে যায় হঠাৎ করে। এজন্য দেশটির সরকার মূলত দায়ী।
খাদের প্রায় কিনারে পড়া দেশটি ঘুরে দাঁড়ালো মুহূর্তেই। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ, শ্রীলঙ্কার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েনি অতটা। দক্ষ আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ঠিকই দায় নিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিচ্ছে। এখন দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ প্রায়।
তিনি বলেন, আর বাংলাদেশ ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি পার করছে। বাংলাদেশে মূলত কোনো জবাবদিহি নেই। ব্যবসায়ীদের মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই। যার যা ইচ্ছা তাই করছে। সরকারও তাই করছে। জনদায় নিয়ে তো কারও ভাবনার সময় নেই। সবাই শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা বোঝেন।
আরও পড়ুন>> বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমছে মূল্যস্ফীতি, বাড়ছে বাংলাদেশে
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যারা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন, তারা শুধু কথা বলেন। প্রতিটি সেক্টরেরই শুধু কথা শুনতে পাই। কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না।
প্রভাব নিয়ে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রথম কষাঘাতে পড়েন সাধারণ গরিব মানুষ। ডিমের দাম ১শ টাকা হালি হলেও ধনীদের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু গরিব মানুষের কাছে পাঁচ টাকা বাড়লেই বড় সমস্যা। ওই পাঁচ টাকাই তাকে ঋণ করতে হবে। সাধারণ মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। হতাশ হচ্ছে। গরিবের সংখ্যা বাড়লে অর্থনীতি কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারবে না।
‘জবাবদিহিতা আসে একটি রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে। কিন্তু রাজনীতি, গণতন্ত্র নিয়ে মানুষ খুব আশাবাদী নয়। রাজনৈতিক সরকার যদি জনগণের কাছে জবাবদিহি করার প্রয়োজনবোধ না করে, তাহলে কোনো জায়গায় আর দায় থাকে না।
আরও পড়ুন>> দেউলিয়া শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ৬০ শতাংশ
মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বাজার পরিস্থিতি দেখলেই বোঝা যায় মানুষ কত কষ্টে আছে। বলতে পারছে না বলেই মানুষ ভালো আছে এমন নয়। আজ নয়, কাল ঠিকই দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা করবেন। নইলে দেওয়াল চাপায় মারা যাবে।
অধ্যাপক এম এম আকাশ তার মতামত জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার যে কয়টি কারণ আছে তার মধ্যে উৎপাদন ব্যয় বেশি একটি। বাংলাদেশের জন্য আমদানি ব্যয় বেশি, যা হয়তো শ্রীলঙ্কার জন্য নয়। আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ার কারণেই উৎপাদন ব্যয় বেশি এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।
তিনি বলেন, জ্বলানি সব কিছুকেই প্রভাবিত করে। এখন মানুষ টের পাচ্ছে। অপরদিকে সরকার মুদ্রা সরবরহ বাড়িয়েছে। সরকারের অতিব্যয় মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ। অনেক প্রকল্প নিচ্ছে সরকার যা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। গত ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবে ব্যয় করেছে। আবার জনস্বার্থে প্রকল্পগুলোর ব্যয়ও অন্য দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। যে অব্যবস্থাপনা আমাদের এখানে তা হয়তো শ্রীলঙ্কায় নেই। সেখানে জবাবদিহি আছে, যা এখানে নেই।
মূল্যস্ফীতির প্রথম আঘাত পেতে হয় সাধারণ মানুষকে। কারণ তাদের আয় সীমিত। সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ঘাটতি দেখা দিলেই সাধারণ মানুষ আর কুলিয়ে উঠতে পারে না। হয় তাকে খাবারের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কমাতে হয়, নতুবা ঋণ করতে হয়। আসলে বাজার পরিস্থিতি শুধু সাধারণ মানুষকেই ভোগাচ্ছে, তা নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও দিশেহারা মূল্যস্ফীতির কারণে।
এএসএস/এএসএ/এমএস