সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কি প্রতি মাসে মিলবে?
সঞ্চয়পত্রের অধিকাংশ স্কিমে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেওয়া হয় তিন মাস অন্তর। তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে চলতি বছরের শুরুর দিকে সব স্কিমে প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয় জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। এরপর কেটে গেছে প্রায় আট মাস। কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীরা প্রতি মাসে মুনাফা পাবেন কি না তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়া সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর দীর্ঘদিন চলে গেলেও এখনো এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে পাবেন কি না সেটি ঠিক করবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর সেটাই বাস্তবায়ন করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি বা কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে না। বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবের ওপর নির্ভর করছে।
আরও পড়ুন>> ব্যাংকে মুনাফা কম, সঞ্চয়পত্র কিনছেন বিনিয়োগকারীরা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তিন মাস অন্তর দেওয়া হয়, সেসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে দেওয়া যেতে পারে। এতে বছর শেষে সরকারের খরচ বাড়বে না। তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে পেলে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন। তাই বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে দেওয়া যেতে পারে।
দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু রয়েছে। এর মধ্যে শুধু পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা পাওয়া যায় প্রতি মাসে। এছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা পাওয়া যায় তিন মাস অন্তর।
আমাদের দেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা লাভজনক। তবে বেশিরভাগ সঞ্চয়পত্র ধনীদের দখলে। আমি মনে করি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি মাসে দেওয়া যেতে পারে। এতে সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ খরচ হবে না। তবে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এটি করা যেতে পারে।-ড. আহসান এইচ মনসুর
চলতি বছরের শুরুর দিকে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশন সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রে প্রতিমাসে মুনাফা দেওয়ার জন্য জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। একই সঙ্গে পেনশন সঞ্চয়পত্রের ক্রয়সীমা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা করা এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রে পুরুষ ক্রেতার বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৫০ বছরে আনারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন>> মেয়াদ পূর্তির পূর্বে সঞ্চয়পত্র ভাঙাবেন যেভাবে
সে সময় অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শাহ আলম সাংবাদিকদের বলেন, তিন মাস অন্তর যেসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো প্রতিমাসে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় ও সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সেখান থেকে অনুমোদন করলে তা কার্যকর হবে।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে এ প্রস্তাব দেওয়ার পর এরই মধ্যে প্রায় আট মাস চলে গেছে। তবে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সঞ্চয়পত্রে প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার বিষয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে প্রস্তাব আসার পর এ বিষয়ে এখনো কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে কোনো কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না। তার মানে এই নয় সঞ্চয়পত্রে প্রতি মাসে মুনাফা পাওয়ার বিষয়টি কার্যকর হচ্ছে না। এটি সম্পূর্ণভাবে সিনিয়র সচিব মহোদয়ের ওপর নির্ভর করছে। তবে আমরা যারা সঞ্চয়পত্র নিয়ে কাজ করি তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের প্রস্তাব যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই পড়ে আছে। প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবটি বাতিল করা বা কার্যকর করা সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা এখন পর্যন্ত আসেনি। তবে সিনিয়র সচিব মহোদয় কখন কী করেন বোঝা মুশকিল। হুট করে দেখা গেলো তিনি এটি নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিলেন। আবার এমনও হতে পারে, এটি নিয়ে কাজ করার কোনো নির্দেশনাই আসছে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি মাসে মুনাফা পেলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীরা সেই টাকা কাজে লাগাতে পারবেন। এতে সুদহারেও কোনো পরিবর্তন আসবে না। সুদহার ঠিক রেখেই প্রতিমাসে মুনাফা দেওয়ার বিধান চালু করা সম্ভব।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেটিই কার্যকর করবো।
আরও পড়ুন>> সঞ্চয়পত্র কারা কীভাবে কিনতে পারবেন?
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা লাভজনক। তবে বেশিরভাগ সঞ্চয়পত্র ধনীদের দখলে রয়েছে। আমি মনে করি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতিমাসে দেওয়া যেতে পারে। এতে সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ খরচ হবে না। তবে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এটি করা যেতে পারে।
পরিবার সঞ্চয়পত্র
১৮ ও তদূর্ধ্ব বয়সের যে কোনো বাংলাদেশি নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী পুরুষ-নারী এবং ৬৫ বছর ও তার বেশি যে কোনো বাংলাদেশি পুরুষ-নারী এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। এ সঞ্চয়পত্রে প্রথম বছর সাড়ে ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর ১০ শতাংশ, তৃতীয় বছর সাড়ে ১০ শতাংশ, চতুর্থ বছর ১১ শতাংশ এবং পঞ্চম বছর ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র
সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এছাড়া আয়কর বিধিমালা, ১৯৮৪ (অংশ-২) এর বিধি ৪৯-এর উপ-বিধি (২) এ সংজ্ঞায়িত স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল এবং ভবিষ্য তহবিল আইন, ১৯২৫ (১৯২৫ এর ১৯ নং) অনুযায়ী পরিচালিত ভবিষ্য তহবিলও বিনিয়োগ করতে পারবে।
মাসে মুনাফা দেওয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেটিই কার্যকর করবো।-মো. এনায়েত হোসেন
পাশাপাশি আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর ষষ্ঠ তফসিলের পার্ট-এ এর অনুচ্ছেদ ৩৪ অনুযায়ী মৎস্য খামার, হাঁস-মুরগির খামার, পেলিটেড পোল্ট্রি ফিডস উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয় উৎপাদিত বীজ বিপণন, গবাদি পশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, উদ্যান খামার প্রকল্প, রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, ছত্রাক উৎপাদন এবং ফল ও লতাপাতার চাষ থেকে অর্জিত আয়, যা সংশ্লিষ্ট উপ-কর কমিশনারের কাছ থেকে প্রত্যয়ন করে এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যাবে।
প্রথম বছর ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং পঞ্চম বছরে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র
সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/অন্য যে কোনো অটিস্টিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান (যাদের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা অটিস্টিকদের সহায়তায় অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে) এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবে। এই সঞ্চয়পত্রে প্রথম বছর ১০ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর সাড়ে ১০ শতাংশ এবং তৃতীয় বছর ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র
এ সঞ্চয়পত্র অবসরভোগী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাবোভোগী স্বামী, স্ত্রী, সন্তানরা কিনতে পারেন।
এ সঞ্চয়পত্রে প্রথম বছরে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং পঞ্চম বছরে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
উৎসে কর
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত সর্বমোট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ হারে এবং এর অধিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয়।
কত টাকার কেনা যায়
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রে সমন্বিতভাবে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অথবা যুগ্ম নামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে।
এমএএস/এএসএ/জিকেএস