ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ
সমুদ্রের ২২ ব্লকে মিলতে পারে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস
বিশাল জলরাশি অঞ্চল হিসেবে সমুদ্রের নানা সম্পদ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর ফলে অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। আধুনিক বিশ্বে মানুষের অদেখা কিংবা অজানা এ সামুদ্রিক সম্পদ ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিশ্বে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। এরই মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে সেদিক থেকে বাংলাদেশের সমুদ্র অনেকটাই অক্ষত এখনো। সামুদ্রিক অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। আর এ সুনীল অর্থনীতির অনুসন্ধানে কাজ করছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
সমুদ্রে বাংলাদেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে খনিজসম্পদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পানিসম্পদ এবং জ্বালানিসম্পদসহ অজানা বহু সম্পদ রয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্লু ইকোনমি : প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয়ের সম্ভাবনা
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মোট ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। যেখানে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈবগুরুত্বপূর্ণ সম্পদের সমাহার। মৎস্যসম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতাগুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে তৈরি করা যায় বিভিন্ন রোগের ওষুধ। স্পিরুলিনা নামক আগাছা চীন, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। গবেষকরা বলছেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশ যে ২২টি ব্লক পেয়েছে সেগুলো থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান ভারী খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ সঠিক উপায়ে উত্তোলন করতে পারলে হাজার কোটি টাকা বা তারও বেশি মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে রয়েছে নৌযান নির্মাণ শিল্প সমৃদ্ধ করার সুযোগও।
আরও পড়ুন: সমুদ্রের ঢেউ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ
দেশে ব্লু ইকোনমির বিপ্লব ঘটাতে সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন করতে চাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে গবেষণার জন্য কক্সবাজারের রামুতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে ৪০ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪ একর জমির ওপর ইনস্টিটিউটটি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভূমির পরিমাণ ১০ গুণ বাড়িয়ে ৪ একরের পরিবর্তে ৪০ একর জায়গার ওপর গবেষণাগার ও মেরিন অ্যাকুরিয়ামসহ এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম শুরু হয়।
‘সমুদ্রে অনুসন্ধান, দেশের কল্যাণ’ স্লোগান ধারণ করে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ভৌত ও স্পেস, ভূতাত্ত্বিক, রাসায়নিক, জৈব, পরিবেশ ও জলবায়ু এ ছয়টি বিভাগের মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬টি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭টি গবেষণা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সমুদ্রসম্পদ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নানামুখী গবেষণা সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার দ্বার খোলার হাতছানি দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: ব্লু ইকোনমিতে মার্কিন বিনিয়োগের আহ্বান
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নির্মিত ভবনটির দোতলায় রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবালসহ সমুদ্রসম্পদ গবেষণার নানা উপকরণ। রয়েছে একটি আধুনিক গবেষণাগার। যেখানে চলে সমুদ্রের নানা অজানা বিষয় নিয়ে গবেষণা। রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ অনেকটা অক্ষত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিছু বিষয় গবেষণায় উঠে আসছে। বৃহৎ পরিসরে কাজ করে সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে।
ইনস্টিটিউটটির তথ্য মতে, বাংলাদেশের উপকূল এলাকা পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম এ তিন ভাগে বিভক্ত। এ তিনটি জোনের মধ্যে পূর্ব এলাকার (কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন) উপকূল ও এর কাছাকাছি অঞ্চলের পানি এবং বালি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভূতাত্ত্বিক প্যারামিটার নির্ণয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান সম্পদ চিহ্নিতের চেষ্টা চলছে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী কক্সবাজার সমুদ্র এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ৮-১৮ পর্যন্ত হেভি মিনারেল (খনিজ) পাওয়া গেছে। জাহাজ নিয়ে সংগ্রহ করা স্যাম্পল বা নমুনা পরীক্ষা করে চিহ্নিত করা হয়েছে ৭২ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, যা ব্লুইকোনমির অপার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রমের মধ্যে ভৌত, রাসায়নিক, জৈব, ভূতাত্ত্বিক সমুদ্রবিদ্যা এবং পূর্ব উপকূলীয় ও সংলগ্ন সমুদ্র অঞ্চলের ওয়াটার কলাম প্যারামিটারের রেললাইন ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে। উপকূলীয় দূষণ নির্ধারণ ও ক্ষয় প্রক্রিয়া নির্ণয়ে গবেষণা করা হয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল থেকে বাণিজ্যিক পণ্য আহরণ, সামুদ্রিক কাঁকড়া চাষ পদ্ধতি নিরূপণ, রাজকাঁকড়া শনাক্তকরণ ও বিস্তার অনুসন্ধান করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্লু-ইকোনমি সহযোগিতা জোরদারে সম্মত বাংলাদেশ-মাল্টা
এছাড়া পূর্ব উপকূলীয় সমুদ্র এলাকার প্রায় ৭ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভারী খনিজ ও পলি বণ্টন প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য সামুদ্রিক ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান সম্পন্ন করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের জেলিফিশের বিতরণ এবং অর্থনৈতিক ব্যবহার পরিমাপ করা হয়েছে। উপকূলীয় সামুদ্রিক এলাকার সম্ভাব্য মাছ ধরার অঞ্চল খুঁজে বের করার জন্য আপওয়েলিং জোন এবং সমুদ্র স্তরবিন্যাস নির্ধারণ করা হয়েছে। শনাক্তকরণ করা হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৬০টিরও বেশি প্রজাতির প্রবাল। এছাড়া মেরিকালচার (মেরিন অ্যাকুয়াকালচার) দ্বারা সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত এলাকা চিহ্নিত করতে ম্যাপিং করা হয়েছে।
ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, ব্লু ইকোনমি উন্নয়নের জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় দেশের পূর্ব উপকূল সংলগ্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার খনিজসম্পদ চিহ্নিতকরণ, ভূতাত্ত্বিক, ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব উপাদানসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারে মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্র উপকূলের তেল নিঃসরণ, মেরিন অ্যাকুয়াকালচার (মেরিকালচার), কাঁকড়া ও ঝিনুক প্রভৃতির খাদ্যগুণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় গভীর সমুদ্রের খনিজসম্পদ চিহ্নিতকরণ ও গবেষণার কাজ হচ্ছে।
সমুদ্রে গবেষণাকে ত্বরান্বিত করতে দ্রুতই একটি বিশেষ জাহাজ দেবে সরকার। তখন গবেষণায় অন্য মাত্রা যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন রিসার্চ ইনস্টিটিউটটির কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: গভীর সমুদ্রে খনন শত শত প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু শরীফ মো. মাহবুব-ই-কিবরিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন দেশের গবেষণায় আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ আমাদের যে বিশাল সমুদ্র অঞ্চল রয়েছে তা অনেকটাই অক্ষত। বর্তমান সরকার সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে গবেষণার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সমুদ্র নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। তাই
ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাইলট কান্ট্রি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি এবং গবেষণার ফলাফল আমাদের আরও বেশি আশাবাদী করছে।
তিনি বলেন, দ্রুতই গবেষণার জন্য একটি নিজস্ব জাহাজ যুক্ত হবে। তখন আরও ভালোভাবে আমরা কাজ করতে পারবো। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সমুদ্র এলাকায় যে পরিমাণ খনিজ, তেল, গ্যাস, মাছসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে, সেগুলো দেশের অর্থনীতি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
আরএসএম/এমকেআর/জিকেএস