ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি নিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যানের বোর্ড মিটিং!

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ০৪ জুলাই ২০২৩
এসএওসিএল কার্যালয়, ইনসেটে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি মঈন উদ্দিন আহমেদ

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অংশীদারি প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির ৮১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে। এরপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো তাকে নিয়ে বোর্ড সভায় যোগ দিয়েছেন স্বয়ং বিপিসি চেয়ারম্যান ও এক পরিচালক। বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এসএওসিএলেরও চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সদুত্তর মেলেনি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।

চট্টগ্রাম আদালতে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু জাগো নিউজকে বলেন, ৮১ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় (মামলা নম্বর- স্পেশাল ০৪/২১) এরই মধ্যে দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। এ মামলার আসামি মঈন উদ্দিন আহমেদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এখনো তিনি জামিন নেননি।

আরও পড়ুন>> এসএওসিএলে কোটি কোটি টাকা তছরুপ, উদ্ধারে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

জানা যায়, ২০১৯ সালের শুরুতে দুদকের হটলাইনে (১০৬) আসা একটি অভিযোগের সূত্র ধরে দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশে কমিশনের উপ-পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমান এবং মোহাম্মাদ মাহমুদুর রহমানকে দিয়ে এনফোর্সমেন্ট টিম গঠন করে দুদক। ওই বছরের ২৮ জানুয়ারি দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম আইএফআইসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংকের ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক শাখায় অভিযান চালিয়ে ‘পিরামিড এক্সিম লিমিটেড’ ও ‘গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড’-এর হিসাবে এসএওসিএলের কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায়।

এসএওসিএল পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাহেদ হলেন ‘পিরামিড এক্সিম লিমিটেড’ ও ‘গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড’-এর নামে-বেনামে অংশীদার। এর মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানকালীন ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যান মোহাম্মদ সাহেদ।

এ ঘটনায় ২০২১ সালের ৯ মার্চ দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্য উপ-পরিচালক মোহাম্মাদ মাহমুদুর রহমান বাদী হয়ে মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৮১ কোটি ১০ লাখ ৩৪ হাজার ২৯১ টাকা আত্মসাৎ এবং ২২ কোটি ৬৮ লাখ ২১ হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ঘটনায় জড়িত থাকলেও মারা যাওয়ায় মোহাম্মদ সাহেদকে অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন>> হাইকোর্টের প্রশ্ন/অর্থপাচার হয়, বিপিসি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়

পরবর্তীসময়ে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর তদন্ত শেষে চলতি বছরের ২৮ মার্চ মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মোহাম্মাদ মাহমুদুর রহমান। সবশেষ গত ৬ জুন মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপরেও গত ১৪ জুন কোম্পানির পর্ষদ সভায় যোগ দেন তিনি।

দুই বছরের বেশি সময় আগে দায়ের হওয়া মামলায় তিন মাস আগে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হলেও বিষয়টি বিপিসি এবং এসএওসিএলের পদস্থ কোনো কর্মকর্তা জানেন না বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে এসএওসিএলের পরিচালক ও বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোর্ড সভা হয়েছে জুমে। মিটিংয়ে পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার নামে মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে কি না কিংবা ওয়ারেন্ট হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’

এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব। ম্যানেজমেন্টের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।’

আরও পড়ুন>> সরকারি লিফট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, জড়িতদের রক্ষায় তোড়জোড়

একই বিষয়ে জানতে চাইলে এসএওসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মণি লাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বোর্ড সভা ১৪ জুন হয়েছিল। গত দু-তিন বছর ধরে আমাদের মিটিংগুলো জুমে (অনলাইন প্ল্যাটফর্ম) হচ্ছে। সভায় পরিচালকরাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অংশ নেন।’

পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৮১ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় চার্জশিট ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার (১ জুলাই) সন্ধ্যায় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি এখনো আমি জানি না। প্রসিডিউর সম্পর্কে আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজর (মেজবাহ উদ্দিন) জানবেন।

এসএওসিএলের যাবতীয় মামলার বিষয়াদি তদারক করেন প্রতিষ্ঠানটির লিগ্যাল অ্যাডভাইজর অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আদালতে দুদকের অভিযোগপত্র জমা দেওয়া এবং গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি শুনেছি। এখনো ডকুমেন্টারি কোনো কাগজপত্র পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো আইনগত প্রশ্ন। প্রতিষ্ঠানটি (এসএওসিএল) ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনে চলে। কোম্পানি আইনে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতের ওয়ারেন্ট থাকা অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের কোনো দাপ্তরিক কাজে অংশ নিতে পারেন কি না, সেটা আমরা দেখবো। তবে এরই মধ্যে চেয়ারম্যান সাহেব মামলার কাগজপত্র সংগ্রহ করতে বলেছেন আমাদের।’

আরও পড়ুন>> লুব অয়েল আমদানির নামে অর্থপাচার, তদন্তে কাস্টমস

সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র হলে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা হলে সরকারি বিধানমতে তিনি দাপ্তরিক কাজে অংশ নিতে পারেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এটি কোম্পানি আইনে চলে। আইনের ওপরে কিছু নেই। তারপরেও এ বিষয়ে আইনগত দিকগুলো দেখবো।’

গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দাপ্তরিক কাজে যোগ দেওয়া নৈতিকতা পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘ওনার (মঈন উদ্দিন আহমেদ) উচিত ছিল, সংশ্লিষ্ট আদালতে সারেন্ডার করে জামিন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজে অংশ নেওয়া।’

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিপিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। মানে তিনি আইনের চোখে ওয়ান্টেড ব্যক্তি। আর ওয়ান্টেড ব্যক্তিকে নিয়ে সরকারি কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া বেআইনি। কারণ যে অপরাধে মামলা হয়েছে, সেটি ওই প্রতিষ্ঠানেরই অর্থ আত্মসাতের মামলা।’

‘সে কারণে মামলা, চার্জশিট, ওয়ারেন্ট সবকিছু সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানার কথা। উপরন্তু ওয়ান্টেড ব্যক্তিকে নিয়ে বোর্ড মিটিং করা মানে এক অপরাধীকে সরকারি লাভজনক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। এতে বোর্ড মিটিংয়ে কর্তৃপক্ষের বাকি যারা অংশ নিয়েছেন তারা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ করেছেন।’

বোর্ড মিটিং জুমে হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মিটিংয়ে যুক্ত হলেও এর মানে তিনি কোথাও না কোথাও রয়েছেন। তিনি বোর্ড মিটিংয়ে যুক্ত হলেও মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী অন্যদের উচিত প্রশাসনকে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো। এখন প্রশাসনের উচিত ওইদিনের বোর্ড মিটিংয়ে কর্তৃপক্ষের যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় এনে তাদের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত ওই পরিচালককে খুঁজে বের করা।’

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিপিসির পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বিপিসির সচিব (সরকারের উপ-সচিব) মুহম্মদ আশরাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে পদস্থ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্র হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার একটা বিধান আছে। তবে বিষয়টি এখনো আমার কাছে আসেনি।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।