‘সরকার আসলে চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪১ পিএম, ০৩ জুলাই ২০২৩

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালেয়ে।

কোরবানির চামড়ার দরপতন ও চামড়া শিল্প প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বিশেষ সিন্ডিকেটের কারণেই কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য মিলছে না উল্লেখ করে বলেন, সরকার অন্য সেক্টরের মতো এখানেও সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: এবারও কোরবানির চামড়ার দুর্গতি। সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও ন্যূনতম মূল্য পায়নি মানুষ। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম যোগানদাতা ছিল চামড়া শিল্প। কী দেখছেন এই শিল্পের ভবিষ্যৎ?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমরা বারবার বলে আসছি রপ্তানি আয়ের অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে চামড়া শিল্প। অন্তত কোনো কারণে যদি পোশাক শিল্পের বিকল্প খুঁজতে হয়, তাহলে চামড়া শিল্প অধিক গুরুত্ব পাবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত দাঁড় করানোর পেছনে এই শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার আগে ও পরে থেকেই রপ্তানি আয়ে বিশেষ অবদান রাখছে। বিগত দিনে ভালো করেই আসছিল।

আরও পড়ুন>> বেশি দামে চামড়া কিনে বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে এক প্রকার ধস, বিশেষ করে কোরবানির চামড়া একেবারেই পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে মানুষকে। আমি মনে করি, সরকার অন্য সেক্টরের মতো এখানেও নজর দিতে ব্যর্থ। আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখতে পাইনি।

জাগো নিউজ: সরকারের নজর কোথায়?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সরকার পড়ে আছে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে। কারণ তৈরি পোশাক খাতের লোকেরাই নানা সিন্ডিকেট তৈরি করে চলছে। সরকারে রয়েছে এই পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা, নীতি-নির্ধারকও তারাই। সরকারের সমস্ত ভাবনা এখন পোশাক নিয়ে। একদম একপেশে। এমনকি প্রণোদনাগুলোও এই পোশাক খাতের মালিকরা পাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, চামড়া শিল্প ঘিরেও বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যেখানে সাধারণ মানুষ অসহায়। কিছুই করার থাকছে না মানুষের।

আরও পড়ুন>> রাস্তায় পড়ে আছে গরুর চামড়া, ছাগলের চামড়া ভাগাড়ে

জাগো নিউজ: সরকার তো চামড়া শিল্পের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে দাবি করছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হলো চামড়া কারখানা। রপ্তানির ব্যাপারেও উদ্যোগী। অথচ কোরবানির চামড়ার মূল্য নেই।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: কারখানা স্থানান্তর করা সব সমস্যার সমধান নয়। সিন্ডিকেট তো একই। হাজারীবাগেও যা, সাভারেও তা।

জাগো নিউজ: লবণের দাম বৃদ্ধি এবং ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এই পরিস্থিতি তৈরি করে বলে বলা হচ্ছে। আসলে কি তাই?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: চামড়ার দুর্গতির জন্য এই কারণগুলো আসলে মুখ্য না। সিন্ডিকেটগুলোই এ হাল করে রেখেছে এবং সরকার তা ভালো করে জানে। আসলে ব্যবসার একটি স্বাভাবিক রূপ থাকে, তা আর নেই। লবণের দাম বাড়িয়ে চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। এটি কোনো নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। সব কিছুর দায় সিন্ডিকেটের।

আরও পড়ুন>> সরবরাহ বেশি থাকায় চামড়ার দাম কিছুটা কম: বাণিজ্যসচিব

আপনি আসলে কারণগুলো আলাদা করে দেখলে সমাধানে আসতে পারবেন না। একটি কারণ আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এর জন্য একটি মহলই দায়ী। কোরবানির চামড়া ঘিরে এক সপ্তাহ সব নিয়ন্ত্রণে রাখে এই সিন্ডিকেট। ট্যানারি মালিক, চামড়া ব্যবসায়ী, লবণ ব্যবসায়ী এক সুতোয় গাঁথা। চামড়া পচনশীল। চাইলেও ঘরে রাখা যায় না। এ কারণে বাধ্য হয় কম দামে বিক্রি করে দিতে।

জাড়ো নিউজ: কোরবানির চামড়ার বড় একটি অংশ সংগ্রহ করে থাকে মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যও বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে বলে অনেকে মনে করেন। আপনার কী মনে হয়?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: যিনি কোরাবানি দেন, তিনি সাধারণত চামড়া বিক্রির টাকা ভোগ করেন না। এ কারণেই বিক্রি, পরিবহন ঝামেলা এড়াতে অনেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দেন। তারা সওয়াবের আশায় এমন করেন। অন্যদিকে এসব শিক্ষার্থীদের বড় একটি আয়ের উৎস কোরবানির চামড়া।

তবে আমি মনে করি, চামড়া না দিয়ে চামড়ার টাকাটা এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিলি করাই উত্তম। শিক্ষার্থীদের এভাবে চামড়া সংগ্রহের পক্ষে আমি না। তাদের কেন ব্যবহার করা হবে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দেওয়ার মানসিকতা থাকলে চামড়া বিক্রি করে নিজে গিয়ে টাকাটা তাদের হাতে দিয়ে আসুক। তাতে চামড়ার দাম নিয়ে কোরবানিদাতা দর কষাকষি করতে পারবেন।

জাগো নিউজ: চামড়ার দামে ধস। চামড়াজাত পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বি। এটি নিশ্চয় খেয়াল করছেন।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সরকারের যে নজরদারি নেই, তার প্রমাণ এটি। চামড়া কিনছে প্রায় ফ্রিতে, অথচ চামড়াজাত পণ্যের দরে আগুন। ৫শ টাকার স্যান্ডেল দুই হাজার টাকা হলো, কেউ নজর দিলো না। কোনো সামঞ্জস্য নেই। চামড়ার মূল্য সঠিক পেলে একজন গরু খামারিও লাভবান হবে। সব কিছু মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। চাইলেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু নেবেন না। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আসলে কী কাজ, তা আর বোঝার উপায় নেই। আমাদের নীতিগুলোরই গোড়ায় গলদ। কৌশলগুলোতেও গলদ রয়েছে। যারা নীতির বাস্তবায়ন করবেন তারাও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত।

জাগো নিউজ: চামড়া শিল্পের কথা উঠলে ভারতের প্রসঙ্গ আসে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ভারত প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে। তারা বিশ্ববাজার ধরতে চাইবেই। বাংলাদেশের চামড়ার বাজারে ভারতের হাত থাকলে তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। ভারত চাইবে বাংলাদেশ রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকুক। কিন্তু আমরা তো এগিয়ে যেতে পারি। ভারতকে দোষ দিয়ে নিজে বসে থাকলে তো হবে না।

চামড়া নিয়ে ছোট ছোট কারখানা ছিল। বাজারে বাজারে জুতা তৈরি করা হতো। এখন আর হয় না। সবাইকে পথে বসিয়ে গুটিকয়েক করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজার দখলে নিয়েছে।

চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির জন্য প্রমোট করা জরুরি। ক্ষুদ্র, মাঝারি ব্যবসায়ীদের এর আওতায় আনলে রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বাড়বে। মানও বাড়বে। বাটার ফ্যাক্টরিতে কয়টি জুতা তৈরি হয়? তারা বাইরে থেকে নামে মাত্র মূল্য দিয়ে কিনে এনে সিল বসিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে।

সরকার আসলে চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। সব দেখছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না।

এএসএস/এএসএ/এএসএম

গত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে এক প্রকার ধস, বিশেষ করে কোরবানির চামড়া একেবারেই পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে মানুষকে। আমি মনে করি, সরকার অন্য সেক্টরের মতো এখানেও নজর দিতে ব্যর্থ

বাংলাদেশের চামড়ার বাজারে ভারতের হাত থাকলে তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। ভারত চাইবে বাংলাদেশ রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকুক। কিন্তু আমরা তো এগিয়ে যেতে পারি। ভারতকে দোষ দিয়ে নিজে বসে থাকলে তো হবে না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।