ঝুঁকছে ঋণে, ভাঙছে সঞ্চয়
কম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ
রিকশাচালক ওবাইদুল। থাকেন রাজধানীর রামপুরার সালামবাগ মসজিদের পাশে নুরের গ্যারেজে। সেখানেই তার দুই বেলা (দুপুর ও রাত) খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যারেজে প্রতি বেলা খাবারের জন্য গুনতে হয় ৭০ টাকা, যা গত বছরও ছিল ৫০ টাকার মতো। বাড়তি এ খরচ প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে এ রিকশাচালকের দৈনন্দিন জীবনে। কারণ গ্রামে পরিবারের জন্য খরচের টাকা জোগাতে হয় তাকে। বাধ্য হয়ে নিজে কম খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
ওবাইদুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘খরচ কিছুটা কমাতে এখন সকালে রুটি-কলা খাই। আগে হোটেলে ডিম-পরোটা দিয়ে নাশতা করতাম। দুপুরে গ্যারেজে ভাত খাই। রাতে বেশিরভাগ সময় না খেয়ে কাটে।’
গ্যারেজে একবেলা খাওয়ার খরচ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন ৭০ টাকায় দুপুরে যা খাই, ৫০ টাকা দিয়ে আগে এর চেয়েও ভালো খেতাম। মাছ-মাংস দেয় না। কালেভদ্রে দিলেও পাঙাস, তেলাপিয়া না হয় ব্রয়লার মুরগি। সেটাও খাওয়া যায় না। তেল-মসলা কিছুই থাকে না। এনিয়ে কিছু বললে মেসমালিক বলেন, পোষালে খাবি, না হলে বাইরে যা।’
দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো, যা ওবাইদুলের মতো নিম্নআয়ের ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, অস্বাভাবিক ডলারের দাম, দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ চাপ বাড়িয়েছে। আমদানি, উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ বাড়ায় দফায় দফায় দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজারে জেঁকে বসেছেন সিন্ডিকেটকারীরা। ফলে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, মসলা, সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে খরচ। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, সবই খাদ্যপণ্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য খরচ করার মতো টাকা তাদের হাতে থাকছে না। খরচের চাপ সামাল দিতে তারা কম খাচ্ছেন।
নিম্নআয়ের মানুষ বলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। সংসার চালাতে পারছেন না। খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের সব টাকা চলে যাচ্ছে। অন্য মৌলিক চাহিদা যেমন- বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ কমাচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ।
আরও পড়ুন>> উৎপাদন খরচের ১০ গুণ বেশি দাম সবজির
রাজধানীর কাজীপাড়া এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন মিলি আক্তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গরু-খাসির মাংস অনেক আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন ডিম-দুধও খাওয়া যাচ্ছে না। গত মাসে ছেলের একটা টিউশনি কমিয়ে দিয়েছি। গত ঈদে কারও কোনো পোশাক কেনা হয়নি। এভাবে আরও কয়েকমাস চললে যে বাসায় থাকছি, সেটাও ছাড়তে হবে। কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে হবে।
তিনি বলেন, মেয়েটা বাড়তি আয়ের জন্য টিউশনি শুরু করেছে। তারপরও সংসার চলছে না। প্রায়ই অসুস্থ হই। সবশেষ যে বার অসুখে পড়েছিলাম, তখন গ্রাম থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসা করিয়েছি। দ্রব্যমূল্য বাড়ায় প্রতি মাসে খরচ ৫-৭ হাজার টাকা বেড়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করবো কীভাবে?’
মিলি আক্তারের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপের তথ্য। গত মার্চে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তারা কম খাচ্ছেন। গত ছয়মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩) ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছেন। ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ডিমও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে, ডজন ১৫০ টাকা
সানেমের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নআয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামের খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে থাকছেন- এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ।
দেশের আট বিভাগের নিম্নআয়ের এক হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ করেছিল সানেম। জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাছ-মাংস ছাড়াও অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা ও ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত কম খাচ্ছে।
সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, বেশিরভাগ নিম্নআয়ের পরিবার ঋণ করে চলছে। বাড়তি আয় তাদের না থাকায়, তারাও সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। যাদের নেই এমন মানুষ মনে করে তাদের ঋণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। দীর্ঘমেয়াদে সমস্যায় পড়ছেন।’
আরও পড়ুন>> আলুর সংকট নেই, তবুও লাফিয়ে বাড়ছে দাম
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এসব সমস্য দীর্ঘমেয়াদি। শুধু ওই পরিবারের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য করের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধরন। দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে বিকল্প উৎস প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। আরও বিস্তৃত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।’
এদিকে, গত বছরের মাঝামাঝি আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাবের চেয়েও প্রকৃত মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। গত বছরের জুনের বাজারদর অনুযায়ী- ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বসবাসরত একজন ব্যক্তির মাসিক খাবার খরচ পাঁচ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এ খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। এরপর দেশের দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েছে। সেই হিসাব মাথায় নিলে জনপ্রতি খরচ আরও প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা বাড়বে।
জনপ্রতি খাবার খরচের সবচেয়ে পাকা হিসাব থাকে রাজধানীর মেস ও হোস্টেলগুলোতে। জানতে চাইলে ৭৩/৪ গ্রিনরোডের ‘সাউথ বেঙ্গল ব্যাচেলর হোম’-এর ম্যানেজার ফয়সাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় বর্তমানে তাদের জনপ্রতি খাবার খরচ এক হাজার ৭০ টাকা বেড়েছে। তারপরও মানসস্মত খাবার দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
দ্রব্যমূলের কারণে হোস্টেল চালানো দায় হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে হারে খরচ বেড়েছে, সেটা মাসিক চার্জের (ভাড়া ও খাওয়া খরচ) সঙ্গে সমন্বয় করলে বর্ডাররা চলে যাচ্ছেন। অনেকেই খরচ বহন করতে পারছেন না। অনেক বর্ডারের আয় বাড়েনি বরং কমেছে। এ কারণে বছরে হোস্টেলের ৩০-৪০ শতাংশ সিট খালি থাকছে।’
আরও পড়ুন>> ধান বেচে উঠছে না উৎপাদন খরচ, দিশেহারা কৃষক
২০০৭ সাল থেকে হোস্টেলে থাকেন টাক্সিচালক বেলায়েত হক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না। রাজধানীতে আগের মতো তেমন যাত্রী পাওয়া যায় না। আগে দিনে দেড় হাজার টাকার বেশি আয় হতো। এখন তা হাজারের নিচে নেমেছে। ঢাকায় মেসভাড়া, খাওয়া খরচ ও গ্রামে পরিবারকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় অর্থনৈতিক চাপে মানুষ। এ কারণে এখন প্রয়োজন না হলে মানুষ গাড়িতে ওঠে না। কষ্ট করে বাসে চলে যান। ঢাকায় মেসভাড়া, খাওয়া খরচ ও গ্রামে পরিবারকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সবাই নিজেদের ব্যয় কমাচ্ছেন। তাতে অতিপ্রয়োজনীয় ছাড়া অন্য বিকল্প যানবাহনগুলোর বেহাল অবস্থা।’
এনএইচ/এএএইচ/এএসএম