চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
৬৭ লিফটে ৯৬ কোটি টাকার প্রস্তাব, কমিশনের প্রশ্ন
একটি প্রকল্পের আওতায় ৬৭টি লিফট কেনা বাবদ ৯৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এমন প্রস্তাবে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে লিফটের সংখ্যা কমিয়ে ৫০টি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন এ খাতে ব্যয় কমিয়ে ৭১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করেছে। পর্যালোচনা সভা ও ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির সুপারিশের আলোকে এ সিদ্ধান্ত এসেছে। তিনতলা বিশিষ্ট উপাচার্য ভবন নির্মাণ বাবদ দুই কোটি ৪২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কমিশন সেখানে দোতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের সুপারিশ করেছে, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
এছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পে পরামর্শকের সংখ্যা কমানোর সুপারিশও করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। অথচ তা কমানোর পরিবর্তে বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। আর এমন সব ঘটনা ঘটেছে ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুরে।
আরও পড়ুন: নির্মাণ চলাকালেই বিলাসী মার্বেলে ফাটল, ৫৬ কোটি খরচ নিয়ে প্রশ্ন
মূল প্রস্তাবিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ডিজাইন এবং সুপারভিশন ফার্মের সার্ভিস খাতে ২৩৪ জনমাস, প্রকিউরমেন্ট পরামর্শক ৬০ জনমাস ও স্বল্পমেয়াদি পরামর্শক ৪৮ জনমাস প্রস্তাব করা হয়। এ তিন ধরনের পরামর্শক সেবায় ৩৪২ জনমাস বাবদ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পর্যালোচনা ও ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির সুপারিশে এ খাতে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করার সুপারিশ ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত ব্যয় সারসংক্ষেপে এ খাতে ৫৭২ জনমাস পরামর্শক আবদার করা হয়। যেখানে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় হ্রাস করলেও কী কারণে জনমাস বাড়ানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে কমিশন।
‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রস্তাবিত প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ১১০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে চার বছর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
গত বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাজধানীর শেরে বাংলানগরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এ প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের সভাপতিত্বে এ সভা হয়।
পিইসি সভা প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য) ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। সভায় প্রকল্পের নানা খাতের ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেক খাতে বাড়তি ব্যয়ও প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি, সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের জবাব দেবে। এরপর একটা কার্যবিবরণী তৈরি করা হবে। সে মোতাবেক প্রকল্পের বিষয়ে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যয় বাড়ছে ১০৪৮ কোটি টাকা
এ প্রকল্পের আওতায় লিফট কেনা বাবদ পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) মো. আব্দুস সালাম খান জাগো নিউজকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন যদি ৬৭টির পরিবর্তে ৫০টি লিফট রাখার সুপারিশ করে ৭১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে, তাতে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে বলবে সেভাবেই আমাদের কাজ করতে হবে। এরপর মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের সময় দ্বিতীয় ফেইসে কিছু কাজ করবো। এখন কমিশনের সিদ্ধান্ত বা সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করবো। প্রকল্পটি আমরা কমিশনে পাঠিয়েছি। পিইসি সভাও হয়েছে। তবে প্রকল্পটি এখনো একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, মূল প্রস্তাবিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের প্রশাসনিক ভবন এবং লাইব্রেরি ১৫তলা, একাডেমিক ভবন ১৫তলা, ডিন অফিস, লেকচার গ্যালারি, ক্যাফেটেরিয়া, প্রার্থনা কক্ষ, টিচারস ক্লাব/লাউঞ্জ এবং কমনরুম ১৫তলার মোট আয়তন ৮০ হাজার ৫৬৯ বর্গমিটার, এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পর্যালোচনা ও ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির সুপারিশ সিদ্ধান্তের আলোকে উপস্থাপিত ব্যয় সারসংক্ষেপে আলোচ্য খাতে ৮০ হাজার ৭২৫ বর্গমিটার আয়তনের বিপরীতে ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ৩৮০ কোটি ২৬২ লাখ টাকা। এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণেরও ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে কমিশন। প্রকল্পের অনুকূলে ২৩ দশমিক ৯২ একর জমি থাকায় অধিগ্রহণের প্রয়োজন নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন: পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণে ৪৮ কোটি ৬৪ লাখের ব্যয়প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন
দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান এবং সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা ও এর আশেপাশের প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এক হাজার ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিষয়ক জনবলের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০টি ফ্যাকাল্টি বিশিষ্ট একটি একাডেমিক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ করা হবে। চিকিৎসাসেবার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে গবেষণা কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ‘রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি এক হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভায় অনুমোদিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে শুরু করে ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল মিলিয়ে মোট শয্যা সংখ্যা ৭৮ হাজার ১৭৮টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সব ধরনের বিশেষায়িত সেবার ব্যবস্থা সেখানে নেই।
আরও পড়ুন: ১১ বছরে মেয়াদ বেড়েছে ৭ বার, ব্যয় বেড়েছে ২৪৯৩ কোটি
মূলত, চট্টগ্রাম বিভাগ তথা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিশেষায়িত শিক্ষা ও সেবা সংক্রান্ত বহু বিভাগ এখনো চালু হয়নি। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হলেও চিকিৎসা, জনশক্তি ও অন্য সুবিধাদি সে হারে বাড়ানো হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য গবেষণায় উন্নত সুবিধার ব্যবস্থা এখনো চট্টগ্রাম বিভাগে নেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগটিতে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেয় সরকার।
এমওএস/এমকেআর/জেআইএম