শেয়ারবাজারে ফের বেপরোয়া কারসাজি চক্র!
২০১৬ সালের পর বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি এমারেল্ড অয়েল। স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির স্থান হয়েছে পচা বা ‘জেড’ গ্রুপে। বছরের পর বছর লভ্যাংশ না দেওয়া এ কোম্পানিটির শেয়ার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এক মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ, যা বেশ অস্বাভাবিক।
গত ২ এপ্রিল কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৩০ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ২ মে লেনদেন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৬৪ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ, এক মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি।
শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি সম্প্রতি ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়েছে। লোকসানে নিমজ্জিত থাকায় কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ তিন বছরেই কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০১৯ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের পর কোম্পানিটি আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এই কোম্পানির শেয়ারের এমন দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এজন্য বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে তথ্যও প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
আরও পড়ুন>> শেয়ারবাজারে বেপরোয়া কারসাজি চক্র, নিষ্ক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা
অভিযোগ উঠেছে, কারসাজির মাধ্যমে একটি বিশেষ চক্র কোম্পানিটির শেয়ার দাম এভাবে বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। শুধু এমারেল্ড অয়েল নয়, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। শেয়ারবাজারে কারসাজি চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠায় এভাবে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ছে।
এই চক্র একের পর এক কোম্পানির শেয়ার দাম কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে এ চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এমারেল্ড অয়েলের মতো শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়া আরেকটি কোম্পানি লিগাসি ফুটওয়্যার। এই কোম্পানিটির শেয়ার দামও এক মাসের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত ১৯ মার্চ কোম্পানিটি প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৪২ টাকা ৩০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ১০ এপ্রিল প্রতিটি শেয়ারের দাম ৯৭ টাকা ৭০ পয়সায় গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ, এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়।
শেয়ারের এমন দাম বাড়া এ কোম্পানিটির আর্থিক ভিতও বেশ দুর্বল। সবশেষ ২০২২ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি একটার পর একটা কোম্পানির শেয়ার দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে এর পিছনে কোনো বিশেষ চক্র রয়েছে। এই চক্রের ভূমিকার কারণে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দাম) এই চক্রের কারসাজি করতে সহায়তা করছে।
তারা বলছেন, সম্প্রতি শেয়ারবাজারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতার দেখা মিললেও, এখনো তালিকাভুক্ত প্রায় ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। বাজারে নিয়মিত গুটিকয়েক কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। আর এসব শেয়ারের পিছনে রয়েছে কোনো না কোনো চক্র। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের লেনদেন না হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এক প্রকার বাধ্য হয়ে কারসাজির এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন।
তারা আরও বলছেন, শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে স্বাভাবিক মূল্য সংশোধনের পর শেয়ারবাজার নিজে থেকেই ঘুরে দাঁড়াবে। আর ফ্লোর প্রাইস অব্যাহত রাখা হলে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসা কঠিন। এই ফ্লোর প্রাইসের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং এর সুবিধা নিচ্ছে কারসাজি চক্র।
আরও পড়ুন>> পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেয়ারবাজারে কারসাজি
সম্প্রতি যেসব কোম্পানির শেয়ার দামের বড় ধরনের উত্থান হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, ওরিয়ন ইনফিউশন, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, জেমিনি সি ফুড, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এডিএন টেলিকম, প্রগতী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, অ্যাপেক্স ফুড, ন্যাশনাল টিসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি। এ কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বাড়ানোর পিছনেও বিশেষ চক্রের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর আগে বিশেষ চক্র প্রথমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির উল্লেখযোগ্য শেয়ার কৌশলে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেন। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর শুরু হয় শেয়ারের দাম বাড়ার প্রবণতা। হু হু করে দাম বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো কোম্পানির শেয়ার কিনতে থাকেন।
আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার মধ্যেই ধীরে ধীরে সরে পড়ে দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখা বিশেষ চক্র। এতে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পরে আবার অস্বাভাবিক দরপতনের ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর বড় দরপতন হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, প্রগতী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ও ন্যাশনাল টি।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ‘এখন শেয়ারবাজারে আইটেমের খেলা হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম হুট-হাট বাড়ছে, তার প্রতিটির পিছনে কোনো না কোনো চক্র রয়েছে। শেয়ারের দাম বাড়ার প্রবণতা এবং লেনদেনের গতি-প্রকৃতি দেখে সহজেই তা বোঝা যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন>> ক্রেতা সংকটে শেয়ারবাজার, নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা
‘শেয়ারবাজারে বিশেষ চক্রের ভূমিকা সব সময় থাকে। তবে সম্প্রতি এই প্রবণতা বেড়ে গেছে। এখন শেয়ারবাজার অনেকটাই এই চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইস এই চক্রকে বিশেষ আইটেম নিয়ে খেলাধুলা করতে সহায়তা করছে। যেহেতু খুব অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে, সেহেতু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাধ্য হয়ে বিশেষ চক্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন বাজারের যে আচরণ তাকে স্বাভাবিক বলা চলে না। বাজার স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসতে হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে হবে। তাতে হয়তো কিছুদিন বাজারে মূল্য সংশোধন হবে। তবে মূল্য সংশোধনের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আবার ক্রেতা ফিরে আসবে, তখন আবার দাম বাড়বে। শেয়ারবাজারের ধর্মই এটা। শেয়ারের দাম কমবে, আবার বাড়বে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটা জায়গায় দাম ধরে রাখার চেষ্টা করলে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়। বিশ্বের কোথাও এমন প্রবণতা দেখা যাবে না।’
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন বাজারে ৭০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইসে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম আটকে রয়েছে। এই ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং, কারসাজি চক্রের লাভ হচ্ছে। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কারসাজি চক্রকেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটার সুযোগ নিয়ে কারসাজি চক্র হুট-হাট একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়াচ্ছে।’
‘এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো দায় নেই। তারা বাধ্য হয়ে কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করছে। কারণ ফ্লোর প্রাইসে থাকা শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। যদি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হতো তাহলে বিনিয়োগের অপশন সৃষ্টি হতো। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, তার সবগুলো ভালো মুনাফা করছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কারেকশন হওয়া উচিত। কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের কারণে হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইসের এ সিদ্ধান্ত কীভাবে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে তা বোঝা যায় না। এটা শেয়ারবাজারের বিরুদ্ধে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুয়াড়িদের প্রমোট করার জন্য বিএসইসি এসব (ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া) করছে। জুয়া খেলা দিয়ে কখনো শেয়ারবাজার ভালো করা যায়নি এবং যাবেও না। এটা কিছু লোকের তামাসার ক্ষেত্র, তাছাড়া কিছুই নয়। পুরো শেয়ারবাজার যখন নড়াচড়া প্রায় বন্ধ হয়ে ২০ শতাংশ নড়াচড়া করে তখন তো জুয়া খেলতে সুবিধা হয়। এখন ঠিক সেটাই হচ্ছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে সত্যিকার বিনিয়োগকারীরা বিপদে আছে। তারা কিনতেও পারে না, বিক্রিও করতে পারে না।’
যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্প্রতি ফান্ডামেন্টাল যেসব কোম্পানির শেয়ার দাম বেড়েছে, আমরা দেখেছি অতীতের তুলনায় এখনো এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমে আছে। তবে জাঙ্ক যেসব কোম্পানির শেয়ার দাম বেড়েছে, সেগুলোকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। কারসাজির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।’
এমারেল্ড অয়েলের দাম বাড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এমারেল্ড অয়েলের ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ধারণা পাওয়া গেছে। কোম্পানিটির বিষয়ে তদন্ত করতে স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এমএএস/এএসএ/এমএস