বিবিএস
এক শুমারিতে শুধু আপ্যায়ন ব্যয় পৌনে ২ কোটি টাকা
একটি নতুন শুমারি প্রকল্পের আওতায় শুধু আপ্যায়ন খাতে এক কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ইন্টারনেট-ফ্যাক্স খাতে ৯ কোটি ৯৫ লাখ ও মনোহারি খাত বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
এ ব্যয় অত্যন্ত উল্লেখ করে যৌক্তিকভাবে কমানোর বিষয়ে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৩’ প্রকল্পে বিবিএসের নানা ধরনের অহেতুক ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ। কমিশনের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকীর সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ প্রশ্ন তোলা হয়। এসব খাতে ব্যয় কমানোর জন্য বিবিএসকে পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন>> কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ছে পুরুষের, কমছে নারীর
মনোহারি খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ খাতের আওতায় এক্সিকিউটিভ ব্যাগ বাবদ দুই হাজার ৫০০ টাকা হারে মোট সাত হাজার ৭৪৪টি ব্যাগের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এসব ব্যাগ শুধু শুমারির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টদের জন্য সংস্থান রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে পাটের তৈরি ব্যাগও দেওয়া যেতে পারে। এতে খরচ অনেক কম হবে। এতে মনোহারি খাতে ব্যয় সাশ্রয় করা যাবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলমান প্রকল্পে প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয় ১ কোটি ৭২ লাখ এবং অডিও, ভিডিও/চলচ্চিত্র নির্মাণ বাবদ ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ব্যয় প্রাক্কলনকালে দ্বৈততা পরিহার করে সাশ্রয়ী হারে ব্যয় প্রাক্কলনের বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬২ কোটি ১০ লাখ টাকা। আরও যাচাই-বাছাই করে প্রশিক্ষণ ব্যয় সাশ্রয় করার সুযোগ থাকলে তা করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন>> মোবাইল ফোন ব্যবহারে শীর্ষে বরিশাল, পিছিয়ে সিলেট
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আমরা পিইসি সভা করেছি। পিইসি সভায় অনেক ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিবিএসকে আরও ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছি। আমরা অনেক জায়গায় কিন্তু ব্যয় কমিয়েছি। কিছু কিছু ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছি। সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আরও সভা করবো যাতে ব্যয় আরও কমানো যায়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিপিপিতে কম্পিউটার সামগ্রী খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খাতে ১৪ কোটি ৮৮ কোটি টাকা। কালার প্রিন্টার টোনার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা হারে ১০০টি, সাদা-কালো প্রিন্টার/ফটোকপিয়ার টোনার ১০ হাজার টাকা হারে ২০০টি, ম্যাপ হালনাগাদের জন্য টোনার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা হারে ২০০টি কেনা হবে। ইউএসবির জন্য ১০ হাজার টাকা হারে ৩০টি, অন্য খাতে থোক হিসেবে ১০ লাখ টাকা, সাদা-কালো প্রিন্টার বাবদ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা হারে ১০টি, রঙিন লেজার প্রিন্টার বাবদ ৫ লাখ টাকা হারে পাঁচটি ইত্যাদিসহ ১৪ কোটি টাকার একটি ক্রয়প্রস্তাব করা হয়েছে।
আরও পড়ুন>> বিয়ে বিচ্ছেদে এগিয়ে রাজশাহী, পিছিয়ে সিলেট
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রতিটি আইটেমের একক দর অত্যধিক। এছাড়া ক্যাপি (কম্পিউটার অ্যাসিসটেড পার্সোনাল ইন্টারভিউইং) পদ্ধতিতে শুমারির তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এত বিপুল সংখ্যক কম্পিউটার সামগ্রী প্রয়োজন নেই। কিছুদিন আগে সমাপ্ত জনশুমারি প্রকল্পে এসব আইটেম কেনা হয়েছিল এবং আবর্তক ব্যয় থেকেও নিয়মিতভাবে এসব খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খাতে সংখ্যা ও পরিমাণ ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পে অফিস সরঞ্জামাদি খাতে পেপার প্রেডার, ফটোকপিয়ার, ট্রলি, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার মেশিন, ওয়াটার ফিল্টার ও অন্য অফিস সরঞ্জামাদির জন্য মোট ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এছাড়া আসবাবপত্র খাতে মোট ২৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং অন্য যন্ত্রপাতি সরঞ্জামাদি খাতে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিবিএসের আগে জনশুমারির জন্য বিপুল পরিমাণে সরঞ্জামাদি-আসবাবপত্র কেনা হয়। পুনরায় এ প্রকল্পের জন্য এত অফিস সরঞ্জামাদি কেনার যৌক্তিকতা নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে কমিশন। সরঞ্জামাদি খাতে ব্যয় কমানোসহ চেয়ার, টেবিল ও আসবাবপত্র খাত সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়ার বিষয়ে মত কমিশনের।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, পরামর্শক ব্যয় খাতে ‘প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন বিষয়ক পরামর্শক’ এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। সম্মানি ভাতা খাতে জনপ্রতি স্টিয়ারিং কমিটির জন্য তিন হাজার টাকা, ওয়ার্কিং কমিটির জন্য তিন হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। সম্মানি খাতের ব্যয়ের সংস্থান রেখে এ খাতে যৌক্তিকভাবে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় চুক্তিভিত্তিক যানবাহন ব্যবহার খাতে ১৮৭টি যানবাহন ৪০ দিনের জন্য ও ১১টি যানবাহন ৩০ মাসের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, যার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে মোট ৮ কোটি ৩ লাখ টাকা। অথচ অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির সভায় শুধু একটি যানবাহন সেবা গ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যানবাহন অনুমোদন বিষয়টি যেহেতু অর্থ বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত কাজেই এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের অনুমোদন অনুসারে ব্যয় করতে হবে।
আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৬ মাস
প্রস্তাবিত প্রকল্পে সেমিনার-কনফারেন্স খাতে যাতায়াত ভাতা জনপ্রতি দুই হাজার, দেড় হাজার ও এক হাজার টাকা হারে এবং অন্য ব্যয়ের জন্য থোক হিসেবে ২০ লাখ টাকাসহ মোট ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে মত পরিকল্পনা কমিশনের।
ইন্টারনেট/ফ্যাক্স/টেলেক্স খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং টেলিফোন/মোবাইল খাতে ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এসব ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি থেকে এসব চাহিদার বিপরীতে প্যাকেজভিত্তিক ‘অফার প্রাইস’ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে নেটওয়ার্ক সুবিধা অনুসারে এলাকাভিত্তিক মোবাইল কোম্পানিকে এসব কাজ দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করে কমিশন।
বিবিএস জানায়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এসআইডি) আওতাধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৩’ শীর্ষক প্রকল্পটি মোট ৬৩১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২৩ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশে বিদ্যমান সব ব্যবসা, শিল্প, সেবা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ প্রণয়ন করার মাধ্যমে সময়ের বিবর্তনে অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে তার স্বরূপ নির্ধারণ করা। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় প্রথবারের মতো পূর্ণাঙ্গ স্ট্যাটিসটিক্যাল বিজনেস রেজিস্ট্রার প্রণয়ন করা হবে।
এর আগে, ৭৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুন ২০১৭ থেকে জুলাই ২০২২ মেয়াদের প্রাথমিক প্রস্তাব ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্তের আলোকে মোট ৬৮৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাবসহ পুনর্গঠিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) তৈরি করা হয়। কতিপয় অসামঞ্জস্য থাকায় তার ওপর পরিকল্পনা কমিশন, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমন্বয়ে আরও একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জনশুমারি প্রকল্পের বাড়তি বরাদ্দ প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিবিএস-মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিবিএসে যোগদানের আগেই ডিপিপি তৈরি হয়েছে। তবে আমরা এটা জানি প্রত্যেকটা প্রকল্প অনুমোদনের কিছু প্রক্রিয়াগত কারণ বা পদ্ধতি আছে। কমিশনের মতামত থাকে, সেটার জবাব দেই। কমিশনকে অনেক সময় ব্যয় প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দিতে হয়। আবার কমিশন যেভাবে চায় সেভাবেও হয়। বিবিএস ও পরিকল্পনা কমিশনের সমন্বয়েই প্রকল্পটি অনুমোদন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
এমওএস/এএসএ/জিকেএস