ভালো লভ্যাংশেও অবহেলিত ব্যাংক

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৫০ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২৩

একটা সময় দেশের শেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হতো ব্যাংক খাত। লেনদেনের সিংহভাগ থাকতো ব্যাংকের দখলে। তবে নানা অনিয়মে জড়িয়ে বেশি কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়। একই সঙ্গে লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বোনাস শেয়ারনির্ভর হয়ে পড়ে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে শেয়ারবাজার থেকেও দাপট হারায় খাতটি।

তিন বছরে ধরে ব্যাংকগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সার্বিকভাবে লভ্যাংশ দেওয়ার হারও। এরপরও বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফেরেনি। ফলে ভালো লভ্যাংশের পরও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ব্যাংকের শেয়ার দাম।

ব্যাংকের শেয়ার অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের ব্যাংক খাত সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এরপরও সার্বিকভাবে ব্যাংকের অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। অধিকাংশ ব্যাংক এখন ভালো অবস্থায় রয়েছে। নিয়মিত ভালো মুনাফার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশও দিচ্ছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের বর্তমান বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় নয়, রাতারাতি মুনাফা পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এ কারণে তারা ভালো লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠান ফেলে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছে।

আরও পড়ুন>> ঈদের আগেও দুশ্চিন্তায় বিনিয়োগকারীরা

তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের আচরণ যুক্তিসঙ্গত নয়। বিনিয়োগকারীদের উচিত বিনিয়োগের আগে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চিত্র ভালো করে পর্যালোচনা করা। আর্থিক চিত্র ভালোভাবে পর্যালোচনা না করে বিনিয়োগ করলে লাভের বদলে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। আর ভালো আর্থিক সক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে তাৎক্ষণিক মুনাফা না পাওয়া গেলেও, দীর্ঘ মেয়াদে ভালো মুনাফা করা সম্ভব।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০২২ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ৯ শেয়ারহোল্ডারের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে একটির লভ্যাংশ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। সাতটির লভ্যাংশ আগের বছরের সমান। আর আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বরাবরের মতো এবারও বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আরও পড়ুন>> লভ্যাংশে ‘সতর্ক’ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভালো লভ্যাংশ ঘোষণার পরও তিনটি ব্যাংকের শেয়ার দাম আটকে রয়েছে ফ্লোর প্রাইসে। এছাড়া লভ্যাংশের ঘোষণা না আসা আরও ২০টি ব্যাংকের শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। আর শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর নিচে রয়েছে সাতটি ব্যাংকের।

লভ্যাংশ ঘোষণা করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে উত্তরা ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের ১৪ শতাংশ নগদ ও ১৪ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২১ সালেও একই লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। তার আগে ২০২০ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ সালে ৭ শতাংশ নগদ ও ২৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ২ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। নিয়মিত এমন বড় লভ্যাংশ দেওয়ার পরও ব্যাংকটির শেয়ার দাম ২৫ টাকায় পড়ে রয়েছে।

দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইস্টার্ন ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালেও ব্যাংকটি একই লভ্যাংশ দিয়েছিল। তার আগে ২০২০ সালে সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ১৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ, ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ দেওয়া ব্যাংকটির শেয়ার দাম এখন (১৫ এপ্রিল) ৩২ টাকা ২০ পয়সা।

সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রাইম ব্যাংক। ২০২১ সালেও ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ নগদ, ২০১৯ সালে সাড়ে ১৩ শতাংশ নগদ, ২০১৮ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ এবং ২০১৭ সালে ৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় প্রাইম ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ার দাম ২০ টাকা ৪০ পয়সা।

গত বছরের সমান লভ্যাংশ দিলেও এবার শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ বেড়েছে। ব্যাংকটি এবার ১২ শতাংশ নগদ ও ৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে ৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।

আরও পড়ুন>> ক্রেতা সংকটে শেয়ারবাজার, নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

বাকি তিনটি ব্যাংকও বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে এরপরও প্রতিষ্ঠান তিনটির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক এশিয়া গত বছরের মতো ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২০ ও ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়। এছাড়া ২০১৮ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংক এশিয়ার শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইস বা ২০ টাকা ২০ পয়সায় আটকে আছে।

শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা আরেক প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ব্যাংক সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালেও ব্যাংকটি একই হারে লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ সালে সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৮ সালে ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে ২৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় ব্যাংকটি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম ৩৮ টাকা ৫০ পয়সা।

সিটি ব্যাংক এবার ১০ শতাংশ নগদ ও ২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালে ব্যাংকটি সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির লভ্যাংশের পরিমাণ কমেছে। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ, ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে ১৯ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইস বা ২১ টাকা ৮০ পয়সায় আটকে রয়েছে।

পূবালী ব্যাংক এবার সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ ও ২০২০ সালেও ব্যাংকটি সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ নগদ, ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৭ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, লভ্যাংশ বিবেচনায় নিলে বর্তমান বাজারে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না। তারা ক্যাপিটাল গেইন চান। দ্রুত মুনাফা পেতে চান। এজন্য আইটেমের পিছনে ছোটেন। আর যারা শেয়ারবাজারে আইটেম নিয়ে খেলে তারা ছোট মূলধনের শেয়ারে বেশি ঝোঁকে। ব্যাংকের শেয়ার বেশি হওয়ার কারণে আইটেমনির্ভর বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। এ কারণেই ভালো লভ্যাংশের পরও ব্যাংকের শেয়ার দাম তলানিতে পড়ে রয়েছে। আইটেমনির্ভর শেয়ারে দ্রুত মুনাফা পাওয়া গেলেও, এতে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপি ঋণসহ সার্বিক ব্যাংক খাতে কিছু সমস্যা আছে। তবে সব ব্যাংক খারাপ নয়। কিছু ব্যাংক এর মধ্যেও ভালো করছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করা। লোভে পড়ে দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে লোকসানের আশঙ্কা বেশি থাকে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকের শেয়ার দাম বাড়লে সার্বিক শেয়ারবাজারে পজিটিভ প্রভাব পড়বে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের শেয়ার দাম খুব একটা বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাতে নানা সমস্যা রয়েছে। অনেক ব্যাংক ছাড় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশনও রাখছে না। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। তবে কিছু ব্যাংক ভালো করছে। এসব ব্যাংকের শেয়ার দাম বাড়তে পারে।

এমএএস/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।