হাজার কোটি টাকার সেমাইয়ের বাজার, এগিয়ে ব্র্যান্ডগুলো
ঈদের সকালে খাবারের তালিকার অত্যাবশ্যক খাবারটি সেমাই। ঈদ ঘনিয়ে এলে পণ্যটির চাহিদা থাকে তুঙ্গে। তবে গত এক দশকে চিত্র কিছুটা বদলেছে। সেমাই এখন পরিণত হয়েছে অনেকের নিত্যনৈমত্তিক খাবারে। উৎসব-পার্বণ ছাড়াও থাকে চাহিদা। সেমাইয়ের বাজারেও এসেছে একটি বড় পরিবর্তন। হাতে তৈরি খোলা সেমাইয়ের বাজার দখল করেছে নামি-দামি ব্র্যান্ডগুলো। সব মিলে পণ্যটির বাজার এখন হাজার কোটি টাকার।
উদ্যোক্তারা জানান, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা ও ভিন্ন স্বাদের কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্যাকেটজাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেমাই। দেশে বছরে সেমাইয়ের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন, যার বেশিরভাগই এখন ব্র্যান্ডের দখলে। এক দশকের ব্যবধানে এ অবস্থান তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় ৩২টি দেশে সেমাই রপ্তানি করছে তারা।
আরও পড়ুন>>ঈদে সুগন্ধি চালেও বাড়তি খরচ
জানা যায়, বছরে যে পরিমাণ সেমাই বিক্রি হয় এর প্রায় অর্ধেক রোজা ও ঈদুল ফিতর ঘিরে। প্যাকেটজাত সেমাই উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সংগঠনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে। আগে শুধু ঈদে সেমাই খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এখন বছরজুড়েই এ খাদ্যপণ্যটির চাহিদা থাকে। ফলে সেমাইয়ের বাজারও বিস্তার লাভ করছে।
তিনি বলেন, এখন বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন সেমাই উৎপাদন হচ্ছে, যা এক দশক আগেও অর্ধেকের কম ছিল। করপোরেট কোম্পানিগুলো এ বাজারকে এক ভিন্নমাত্রায় এনেছে। বেশকিছু কোম্পানি সেমাই রপ্তানি করছে।
প্যাকেটজাত সেমাই স্বাস্থ্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব সেমাই আধুনিক কারখানায় উৎপাদিত এবং মানসম্মতভাবে বাজারজাত করা। মানুষ এখন স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশি যত্নশীল, সেটাও সেমাইয়ের বাজার বড় হওয়ার কারণ।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে ঈদ মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমাই রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। জানা যায়, আমেরিকা-ইউরোপসহ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সেমাই রপ্তানি করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে প্রাণ, স্কয়ার, কিশোয়ান, ইস্পাহানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সেমাই বিদেশে রপ্তানি করেছে।
আরও পড়ুন-দেখুন>>জমে উঠেছে নতুন টাকার বাজার
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেমাইয়ের বাজার মোটা দাগে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো হলো- সাধারণ বেকারির তৈরি, ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ড এবং প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত সেমাই। সাধারণ বেকারির মধ্যে আবার অধিকাংশ শুধু ঈদকেন্দ্রিক। অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রিয় ব্র্যান্ডও রয়েছে। যেমন- উত্তরবঙ্গে বগুড়ার আকবরিয়া একটি জনপ্রিয় সেমাইয়ের ব্র্যান্ড। ওই এলাকা থেকে এশিয়া, শ্যামলী, কোয়ালিটি, খাজা বেকারি, ফুড ভিলেজের মতো আরও বেশ কিছু ব্র্যান্ড সারা দেশে সেমাই বিক্রি করছে।
এতকিছুর মধ্যেও বড় কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সারা বছর এসব কোম্পানির সেমাই বাড়ির পাশের দোকানে পাচ্ছেন ক্রেতারা। এর মধ্যে প্রাণ, বনফুল, কিশোয়ান, কুলসন, এসিআই, বিডিফুড, বসুন্ধরা, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, ডেকো ও ওয়েল ফুড দেশে তৈরি সেমাইয়ের বড় ব্র্যান্ড। বড় বিনিয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অঙ্গীকারে এসব প্রতিষ্ঠানের সেমাই এখন গ্রাহক চাহিদার শীর্ষে।
বাজারে সেমাইয়ের দাম এবার কিছুটা বাড়তি। বিশেষ করে ২০০ গ্রামের সেমাইয়ের প্যাকেটের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আগে ২০০ গ্রাম প্রতি প্যাকেট সাদা সেমাই ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও এবছর ব্র্যান্ডভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। একই পরিমাণ লাচ্ছা সেমাই ৪০-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০-৭০ টাকা।
দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো সেমাই তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার পর ছোট বেকারিগুলো এ পণ্যটির উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। একসময় স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই জনপ্রিয়তা পেলেও এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না মাঝারি বা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।
আরও পড়ুন>>সাশ্রয়ী দামে পছন্দের কেনাকাটায় রাজধানী সুপার মার্কেট
একসময় সেমাই উৎপাদনে জনপ্রিয়তা পাওয়া বগুড়ার এমন অনেক কারখানা এখন বন্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কিট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বায়েজিদ শেখ জাগো নিউজকে বলেন, এখন এ এলাকায় দেড়শো কারখানা রয়েছে। যেখানে আগে আরও কয়েকশো কারখানা সেমাই বানাতো। এর বাইরে আরও কিছু ব্যবসায়ী শুধু ঈদে সেমাই তৈরি করতেন। সেগুলো এখন নেই। তারা খরচের সঙ্গে টিকতে পারছেন না। এর মধ্যে এবছর ময়দা, চিনি তেলসহ অন্য সব উপকরণের দাম বাড়ার কারণে অনেকে লোকসানের আশঙ্কায় সেমাই তৈরি বন্ধ করে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যেত। তাদের মধ্যে করাচি সেমাই, বিউটি সেমাই, গোল্ডেন সেমাইসহ এমন আরও অনেক নামই পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্র্যান্ডের হাতে বাজার চলে যাওয়ায় আঞ্চলিক ছোট কারখানাগুলো এখন সেমাই তৈরিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনকি এ ধরনের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
ঈদ ঘিরে বাজারে দুই ধরনের সেমাই বেশি পাওয়া যায়। একটি লাচ্ছা সেমাই, অন্যটি চিকন সেমাই। লাচ্ছা সেমাই আবার তৈরি হচ্ছে ডালডা অথবা ঘিয়ে ভেজে। তবে দেশের মানুষের কাছে দুই ধরনের সেমাইয়েরই সমান কদর।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের সেমাই ব্যবসায়ী নন্দী স্টোরের কার্তিক নন্দী জাগো নিউজকে বলেন, দুই ধরনের সেমাইয়েরই চাহিদা বেশি। বিশেষ করে শহুরে মানুষ ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই বেশি পছন্দ করে। গ্রামে সাদা সেমাই বেশি চলে। আগে লাচ্ছা সেমাই খোলা বেশি চলতো, কিন্তু এখন প্যাকেট ছাড়া মানুষ নেয় না।
এবার ঈদের বাজারে সেমাইয়ের বেচাকেনা কেমন, জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী বলেন, রমজানের শুরু থেকে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সেমাই কিনে নেন। গত দুই বছর করোনা সংক্রমণের কারণে বেচাবিক্রি ভালো ছিল না। এবার সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। বেচাকেনা ভালো।
ব্র্যান্ডগুলোর প্যাকেটজাত সেমাই আবার বিক্রয়কর্মীদের মাধ্যমে দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে কোম্পানিগুলো। ফলে এখন পাইকারি বাজারেও সেমাইকেন্দ্রিক ক্রেতাদের আনাগোনা আগের তুলনায় অনেক কমেছে বলে জানান পুরান ঢাকার এ সেমাই ব্যবসায়ী।
ঈদে ভোক্তা পর্যায়ে বনফুল গ্রুপের লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বরাবরই তুঙ্গে। বনফুল অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, রুচির পরিবর্তন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা- এ তিন কারণে এখন বাজারে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পণ্যটির রপ্তানিও বাড়ছে। শুধু ঈদে নয়, সেমাইয়ের ভালো চাহিদা এখন বছরজুড়েই।
তিনি বলেন, এবার বনফুল ও কিশোয়ান ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। আমাদের উৎপাদিত সেমাই এরই মধ্যে প্রায় সবটুকু বেচা হয়ে গেছে।
এনএইচ/এএসএ/জিকেএস