‘জাল’ শিক্ষা সনদধারীকে সিইও করতে চায় ডেল্টা লাইফ
বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান হলেও এবার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। প্রতিষ্ঠানটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ এমন একজনকে সিইও নিয়োগ দিতে চাচ্ছেন যার শিক্ষা সনদ জাল বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সিইও হিসেবে শহিদুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শহিদুল ইসলাম এর আগে সানলাইফ, বেস্ট লাইফ ও চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করেছেন। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ২০২০ সালে শহিদুল ইসলামের শিক্ষা সনদ যাচাই করা হয়। সে সময় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি শাখা থেকে শহিদুল ইসলামের বিএ এবং এমএ পাসের সনদ দুটি ইস্যু করা হয়নি বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়।
জানা যায়, শহিদুল ইসলাম সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০১৯ সালের ২৩ মে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরি নেন। পরের বছর অর্থাৎ, ২০২০ সালের ৪ জুন তিনি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্ব পান। তবে ওই বছরের ২ নভেম্বর সানলাইফ থেকে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
কোম্পানিটিতে চাকরি নিতে শহিদুল ইসলাম দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির অননুমোদিত ক্যাম্পাস মিরপুর-১০ থেকে ইস্যু করা ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) ও মাস্টার্স অব আর্টস (এমএ) পাসের দুটি সনদ দাখিল করেন। সনদ দুটির তথ্য অনুসারে, ২০১০ সালে তিনি সিজিপিএ ৩.৫১ নিয়ে বিএ এবং ২০১১ সালে সিজিপিএ ৩.৫৪ নিয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
সানলাইফের চাকরি ছাড়ার আগে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ শহিদুল ইসলামের শিক্ষা সনদ যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়কে শহিদুল ইসলামের সনদ দুটি যাচাইয়ের সুপারিশ করে চিঠিটি পাঠায়।
ওই চিঠির জবাবে ৩১ আগস্ট দারুল ইহসান ট্রাস্টের প্যাডে সনদ দুটির বিষয়ে মতামত পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ। মতামতটি ছিল- ‘সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর উল্লেখিত প্রোগ্রামের সনদপত্র দুটি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ী নং ২১, রোড-৯/এ, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা-১২০৯ থেকে ইস্যু করা হয়নি।’
দারুল ইহসানের চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মো. শহিদুল ইসলামের সনদ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত রেকর্ডের সঙ্গে যাচাই করে মতামত দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে সই করেন দারুল ইহসান ট্রাস্টের সচিব। অবশ্য সেখানে সচিবের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন মতামত দেওয়া হলেও শহিদুল ইসলাম দাবি করেন, তার সনদ দুটি সঠিক। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে শহিদুল ইসলামকে প্রশ্ন করা হয় সানলাইফ থেকে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হলে তারা জানায় আপনার বিএ ও এমএ’র শিক্ষা সনদ তারা ইস্যু করেনি।
উত্তরে শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, না এ রকম কোনো কিছু নেই। আমি যেখানের, সেখানে তারা পাঠায়নি। এটা আসছিল এবং প্রটেস্টও আছে। যারা দিছিলো তাদের প্রটেস্টও করা হয়েছে। এটা ভোগাস।
আপনি বলছেন- আপনি যেখানের ওনারা সেখানে পাঠায়নি, তাহলে আপনি কোন জায়গার এবং ওনারা কোথায় পাঠিয়েছিলেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি মিরপুরের। ওনারা কোথায় পাঠিয়েছিলেন আমি জানি না। আমাকে কেউ বলেনি।
এদিকে সানলাইফের আগে শহিদুল ইসলাম ২০১৫ সালের ৫ মে চাকরি নেন চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। এ কোম্পানিটিতে তিনি পৌনে চার বছর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করেন। অথচ বিমা আইন অনুযায়ী প্রথম দফায় তিন মাস ও দ্বিতীয় দফায় আরও তিন মাস অর্থাৎ, ছয় মাসের বেশি কোনো কোম্পানিতে চলতি দায়িত্বে কোনো ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। শহিদুল ইসলাম চার্টার্ড লাইফের চাকরি ছেড়ে দেন ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি।
শিক্ষা সনদ জাল হওয়ার অভিযোগ ওঠা এবং আগে কোনো কোম্পানিতে পূর্ণাঙ্গ সিইও’র দায়িত্ব পালন না করা এমন একজন ব্যক্তিকে ডেল্টা লাইফের সিইও করার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর দেননি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জেয়াদ রহমান। তবে তিনি স্বীকার করেন শহিদুল ইসলামকে সিইও করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার নিয়োগ অনুমোদনের জন্য এখনো (২ এপ্রিল পর্যন্ত) বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে আবেদন পাঠানো হয়নি বলে জানান জেয়াদ রহমান।
অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদকে সাসপেন্ড করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একই সঙ্গে আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে দেড় বছরে তিন দফায় প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়।
অবশ্য প্রশাসক নিয়োগের আগেই আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুস দাবি করার অভিযোগ তোলে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছে।
দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান। ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ।
ডেল্টা লাইফে প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা পরবর্তীসময়ে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়ান। ডেল্টা লাইফে প্রশাসক থাকা অবস্থায় কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়া নিয়মবর্হিভূতভাবে মাস্ক কেনার অভিযোগে তাকে কারাগারেও যেতে হয়।
আর ডেল্টা লাইফ নিয়ে জড়ানো বিতর্কের জেরে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে হয়েছে এম মোশাররফ হোসেনকে। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল আইডিআরএ সদস্য (লাইফ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোশাররফকে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিন বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে হিসেবে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই ২০২২ সালের ১৫ জুন তিনি পদত্যাগ করেন। ওই দিনই আইডিআরএ’র নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
এরপর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দুটি আলাদা আদেশে ডেল্টা লাইফ থেকে প্রশাসক প্রত্যাহার ও কোম্পানিটি পরিচালনায় নতুন পর্ষদের দায়িত্ব দেয় আইডিআরএ। কোম্পানি পরিচালনায় নতুন পর্ষদকে বেশকিছু শর্ত দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত ছিল- পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ বিমা আইন ও অন্য আরোপিত বিধি-নিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে দ্রুত একজন দক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করবে।
এমএএস/এএসএ/জেআইএম