বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস
বাজারজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ, অনিয়মে পিছিয়ে নেই কেউই
সাধারণ মুদিদোকান থেকে শুরু করে বড় সুপারশপ, রাস্তার পাশের খাবারের দোকান কিংবা নামিদামি রেস্তোরাঁ—সবখানেই এখন অনিয়ম। এর বাইরে নয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষও। বাজারজুড়ে যেন ভোক্তাদের জন্য প্রতারণার ফাঁদ। যেখানেই অভিযান চালানো হয়, মেলে অনিয়ম-প্রতারণার প্রমাণ। খোদ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এমন তথ্য জানিয়েছে।
২০০৯ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ৬২ হাজার ৯টি অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর। তাতে এক লাখ ৪৬ হাজার ৬৬০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম পেয়েছে সংস্থাটি। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানে ভোক্তারা প্রতারিত হয়ে আসছিলেন।
ভোক্তা অধিদপ্তর বলছে, বাজার তদারকিতে গেলেই পণ্যের মূল্যতালিকা না থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা একেবারে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেজালপণ্যের মিশ্রণ, ওজনে কারচুপি, পণ্যের মোড়কে দাম, ওজন ও মেয়াদ না থাকার প্রবণতা পাওয়া যায়। থাকে না ক্রয়মূল্যের রশিদ। আবার বিক্রয়মূল্যের রশিদ না দেওয়ার প্রবণতাও পাওয়া গেছে। দামি পণ্যের অর্ডার নিয়ে কম দামি পণ্য সরবরাহ করা, ত্রুটিপূর্ণ-নিম্নমানের পণ্য দেওয়া, গ্রাহকের সঙ্গে বাজে আচরণ, মিথ্যা, বাহারি ও নামিদামি তারকা, মডেল ও খেলোয়াড়দের ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়া ও পণ্যের মজুত থাকার পরও সরবরাহ না করার মতো প্রতারণা করে যাচ্ছে এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান।
সুলতানস ডাইনে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান
আবার পণ্য উৎপাদনকারীদের ক্ষেত্রে সরকারি সনদ না নিয়ে উৎপাদন, মোড়কজাত আইন লঙ্ঘন, ওজনে কম দেওয়া এবং অন্য ব্র্যান্ডের সুপরিচিত পণ্যের আদলে পণ্য তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্বোধ্য ও ভোক্তা স্বার্থবিরোধী শর্তজুড়ে দিয়ে ভোক্তাদের বোকা বানাচ্ছেন। উৎসব ঘিরে যেমন- ঈদ, পূজার সময় লোভনীয় অফারের ফাঁদে ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা।
আরও পড়ুন>> সুলতান’স ডাইনের মাংসের উৎস নিয়ে ‘সন্তোষজনক’ উত্তর মেলেনি
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনা করছেন সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল। অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনৈতিক মুনাফা করার প্রবণতা ভোক্তা প্রতারণার প্রধান কারণ। খাদ্যে ভেজাল বা রং মেশানো লাভের জন্যই। মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করাও একই কারণে। মূল্যতালিকা থাকলে তিনি কারও কাছে বাড়তি আদায় করতে পারবেন না। পণ্যের মান খারাপ করা, অবৈধ পণ্য বিক্রি, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য ভোক্তাকে গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আইনের প্রতি অনীহা দূর করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভোক্তারাই পণ্যের নিয়ামক। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের অবস্থান দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। ব্যবসায়ীরাই নির্ধারণ করছেন ভোক্তারা কতটুকু সুবিধা পাবেন, কিংবা পাবেন না। দাম নির্ধারণ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি পুরোটায় তাদের নিয়ন্ত্রণে।
আরও পড়ুন>> ব্রয়লারের কেজি ২৫০ টাকা কেন, খতিয়ে দেখা হবে: ভোক্তার ডিজি
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ দেশে ভোক্তারা বরাবরই পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে অন্যায্যতার শিকার। ভোক্তারা অসচেতন, অসংগঠিত বলে প্রতারণার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এজন্য বাংলাদেশের ভোক্তাদের বলা হয়ে থাকে হেল্পলেস কনজ্যুমারস বা অসহায় ভোক্তা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার কাজ করছে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। জনবল বাড়াতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য কঠিন আইন ও কার্যকর শাস্তির বিধান প্রয়োজন।’
মুরগি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতবিনিময়
ভোক্তার অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের বিদ্যমান সক্ষমতা যথেষ্ট কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের জনবল কম, সেটা ঠিক। সারাদেশে আমাদের যে পরিমাণ কাজ, সেই আলোকে জনবল কাঠামো অপ্রতুল। ৪৬৫ জন নতুন জনবল চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। শিগগির আরও কিছুটা গতি আসবে।
আরও পড়ুন>> সারাদেশে জমজমের পানি বিক্রি বন্ধ: ভোক্তার ডিজি
২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কিছু দুর্বলতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোনো আইনটি যুগোপযোগী করা হচ্ছে। এরমধ্যে দিয়েও আমাদের কার্যক্রম অনেক গতিশীল হয়েছে। আমরা অভিযোগের প্রায় ৯৫ শতাংশ নিষ্পত্তি করছি। অনেক সময় অভিযোগকারীরা ডকুমেন্ট (প্রয়োজনীয় কাগজপত্র) দেন না। এ কারণে তা নিষ্পত্তি করাও সম্ভব হয় না। যদিও আইনের কারণে ই-কমার্সের বিষয়ে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। প্রায় ১১-১২ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে রয়েছে। এখন আমরা সেবা খাতে কাজ করতে চাই। এখানে প্রতারণা হচ্ছে। পরিবহন খাত ও রেলসেবা, ওয়াসা ও গ্যাস, বিমানের টিকিট, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে।’
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস আজ
এদিকে, দেশে ভোক্তা পরিস্থিতির এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার (১৫ মার্চ) ‘বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস’ পালিত হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনে নানান আয়োজন করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী’।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতবিনিময়
আরও পড়ুন>> রমজানে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধে ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অধিদপ্তর। প্রতি বছর বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসও পালন করে এ সংস্থা।
ভোক্তা অধিকার দিবসের কর্মসূচি
প্রতি বছরের মতো এবারও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তর বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
আরও পড়ুন>> ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব
তিনি সেখানে ‘সিসিএমএস’ নামের অ্যাপ উদ্বোধন করবেন। ভোক্তারা এ অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই অভিযোগ করতে পারবেন। এছাড়া একটি স্মরণিকা প্রকাশ হবে, যার মোড়ক উন্মোচন করা হবে এ অনুষ্ঠানে। ঢাকার পাশাপাশি সব বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়েও দিবসটি উদযাপন করা হবে।
এনএইচ/এএএইচ/এমএস